সন্তানের হৃদয়ের গভীরতম শঙ্কা, মায়ের বয়স বাড়ছে

মায়ের বয়স যত বাড়ে, তাঁর শক্তি তত কমতে থাকে। অথচ তিনিই সন্তানের সাফল্যের প্রথম দর্শক, ব্যর্থতার শেষ আশ্রয়ছবি: এআই/বন্ধুসভা
আমরা যত বড় হচ্ছি, ততই মা যেন ছোট হয়ে যাচ্ছেন—শক্তিতে, দেহে, সহ্যশক্তিতে। পৃথিবীর কাছে এটা স্বাভাবিক নিয়ম, কিন্তু সন্তানের হৃদয়ে এক অসহনীয় বাস্তবতা।

‘মায়ের বয়স বাড়ছে’—এই ছোট্ট বাক্যটির মধ্যে লুকিয়ে আছে হাজারো সন্তানের নিঃশব্দ কান্না। পৃথিবীতে এর চেয়ে বড় দুঃসংবাদ আর কিছু আছে কি? মা সন্তানের প্রথম আশ্রয়, প্রথম নিরাপত্তার দেয়াল। মায়ের বয়স বাড়া মানে সেই আশ্রয় ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাওয়া।

ছোটবেলায় প্রতিটি সমস্যার সমাধান ছিল একটাই—‘মা’। খেলনা ভাঙলে, স্কুলে যেতে ভয় পেলে, কিংবা জ্বরে কাঁপতে থাকলে, দৌড়ে গিয়ে মাকে ডাকলেই যেন সবকিছু সহজ হয়ে যেত। মায়ের স্নেহভরা হাত, মায়ামাখা চোখ আর আশ্বাসের হাসিই সন্তানের জীবনের শক্তি।

আজও সেই অভ্যাস বদলায়নি। আমরা প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছি, সংসার করছি, চাকরি করছি; কিন্তু কোনো না কোনো মুহূর্তে এখনো দৌড়ে গিয়ে মায়ের কাছে ভরসা চাই। অথচ সময় যেন প্রতিদিনই মনে করিয়ে দেয়—একদিন হয়তো আর তাঁকে কাছে পাওয়া যাবে না।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে পরিবর্তন আসে। ক্লান্তি জমে ওঠে, হাঁটার ভঙ্গি বদলে যায়, চোখের আলো ম্লান হয়ে আসে, চুলে পাক ধরা শুরু হয়। অথচ সন্তানের মনে মা সব সময় একই—সেই তরুণী, যিনি শাড়ি পরে সকালবেলা স্কুলে হাত ধরে নিয়ে যেতেন, রাতে বুকের ভেতর জড়িয়ে ঘুম পাড়াতেন। আমাদের কাছে মা চিরকাল অপরিবর্তনীয়। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মে তাঁকে ধীরে ধীরে বদলাতে হয়। এটাই সন্তানের হৃদয়ের কাছে সবচেয়ে বড় কষ্ট।

মায়ের বয়স যত বাড়ে, তাঁর শক্তি তত কমতে থাকে। অথচ তিনিই সন্তানের সাফল্যের প্রথম দর্শক, ব্যর্থতার শেষ আশ্রয়। পরীক্ষায় ভালো করলে তিনি সবচেয়ে বেশি খুশি হন, ব্যর্থ হলে তিনিই ভরসা দেন। সন্তান রাত জেগে পড়াশোনা করলে তিনিও জেগে থাকেন, শুধু এই ভয়ে—সন্তান যেন একা না হয়। সন্তানের প্রতিটি পদক্ষেপে তাঁর নিঃশব্দ ত্যাগ জড়িয়ে থাকে।

আমরা যত বড় হচ্ছি, ততই মা যেন ছোট হয়ে যাচ্ছেন—শক্তিতে, দেহে, সহ্যশক্তিতে। পৃথিবীর কাছে এটা স্বাভাবিক নিয়ম, কিন্তু সন্তানের হৃদয়ে এক অসহনীয় বাস্তবতা। মায়ের বয়স বাড়া মানে তাঁর জন্য বাড়তি যত্নের প্রয়োজন। মানে প্রতিটি দিনকে আরও গভীরভাবে অনুভব করা প্রয়োজন।

আরও পড়ুন

প্রশ্ন হলো—আমরা কি যথেষ্ট সময় দিচ্ছি? আমরা কি তাঁকে বলছি, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি?’ প্রতিদিনের ব্যস্ততায় অনেক সময়ই এসব প্রকাশ করতে ভুলে যাই। একদিন হয়তো বলার অনেক কিছুই থেকে যাবে, অথচ বলার সময় আর থাকবে না।

বাংলাদেশে গড় আয়ুষ্কাল বেড়েছে—নারীদের জন্য এখন প্রায় ৭৪ বছর। কিন্তু সেই সঙ্গে বেড়েছে বয়সজনিত রোগ, একাকিত্ব আর মানসিক চাপ। সংসার, সন্তান ও আত্মীয়দের জন্য সারা জীবন সবটুকু দিয়ে দেওয়া মায়েরা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হয়ে পড়েন সবচেয়ে অবহেলিত। অনেক সন্তানই তখন দূরে থাকে, কেউ হয়তো বিদেশে, কেউ ব্যস্ত শহরের চাকরিতে। ফলে মা হয়ে যান নিঃসঙ্গ।

কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না—মায়েদের হাতেই গড়া প্রতিটি পরিবার, প্রতিটি সমাজ। তাঁদের বয়স বাড়া মানে আমাদের দায়িত্ব আরও বেড়ে যাওয়া।

পৃথিবীর যত ভালোবাসা আছে, তার সবটুকু এক পাশে রাখলেও মায়ের ভালোবাসার ওজন বেশি হবে। এই ভালোবাসার ভেতর আছে নিঃস্বার্থ ত্যাগ, নিরন্তর প্রার্থনা, আর এক অদ্ভুত স্নেহ, যা কেবল মা-ই দিতে পারেন।

মায়ের বয়স বাড়ছে—এটা একদিকে স্বাভাবিক সত্য, অন্যদিকে সন্তানের কাছে অসহনীয় দুঃসংবাদ। এই বয়স আমাদের মনে করিয়ে দেয়—মাকে আগলে রাখার সময় এখনই। তাঁর যত্ন নেওয়া, পাশে থাকা আর ভালোবাসা প্রকাশ করা—এগুলোই সন্তানের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।

কর্মকর্তা, ভূমি মন্ত্রণালয়