করোটির কথামালা (পর্ব ১০)

কানাডাছবি: ফ্রিপিক
যেসব বাংলাদেশি এসেছি এই এলাকায়, বুঝে বা না বুঝে পরিকল্পনা করে এসেছি বা অনেকটা পরিকল্পনা ছাড়াই; এখানে এসে নিজেদের বলেছি....

শীতের কনকনে বুড়ি শহরের দরজায় কড়া নাড়ছে। জোড়ে জোড়ে সেই শব্দ সব বাড়িতে পৌঁছে যাচ্ছে। তবু আমাদের অবাক করে দিয়ে কয়েকটা দিন উজ্জ্বল হয়েও দেখা দিচ্ছে। সামনেই ১৮ অক্টোবর, এই শহরে হ্যালোইন ভূত আসবে, ভীষণ বাতাস ছাড়বে সেদিন; শিশুরা হইহই করে চকলেট আনতে বের হবে, বয়স্ক ব্যক্তিরা হয়তো এ বছর মুখে মাস্ক পরে দূর থেকে শিশুদের চকলেট দেবে, ভূত দিয়ে সাজিয়ে রাখবে বাড়ির সামনে। এরপরই আসবে শীত, সেই সঙ্গে উত্তরের প্রচণ্ড কনকনে হাড়কাঁপানো বাতাস।

টরন্টো শহরে আমাদের মতো অভিবাসীদের বয়স বাড়ে, প্রতিটি বছরের সঙ্গে একটা বছর যোগ হয়; কিন্তু কিছু দিন-তারিখ ভুল হয় না। করোটির অন্ধকার গোপন শিরায় আমরা রেখে দিই জীবনের সেরা সম্পদের মতো কয়েকটা তারিখ, দিন/ক্ষণ। কিছুতেই ভুলতে দিই না সেই সব দিন। যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখি। সব সফলতায়-ব্যর্থতায় দিনগুলো আমাদের ক্রমাগত শক্তিশালী করে।

কবে সেই দিন, যেদিন আমি এই শহরে প্রথম পা রেখেছিলাম?
২০০৪ সালের ২০ ডিসেম্বর।
এই শহরে প্রথম কয়েক দিন কেমন লেগেছিল বলতে পারো?
সব অনুভূতি লেখা আছে হৃদয়ে।
কবে এই শহরে পড়া শুরু করেছিলে, প্রথম ক্লাসের অভিজ্ঞতা কেমন?
একমুহূর্তের জন্যও ভুলব না।
প্রথম দিনের কাজ বা প্রথম যেদিন ‘পে চেক’ পেলে, মনে পড়ে দিনটা?
কী করে ভুলি সে কথা?
কোনো দিন কি ভেবেছিলে এই দেশে থেকে যাবে তুমি?
একমুহূর্তের জন্যও ভাবিনি। এখনো আছি, কিন্তু নিজেকে বিশ্বাস হয় না আজও।

বাংলাদেশের কোনো পাঠক এই অনুভূতি বা নিজের কাছে আউড়ে চলা এই অবিরাম প্রশ্ন/উত্তর বুঝবেন না। কিন্তু আমার এলাকার বা এই যে শহরে যেখানে থাকি, বাঙালি–অধ্যুষিত এলাকা ‘স্কারবোরো’, যেখানে ৯৭ ভাগ দক্ষিণ এশিয়ান মানুষের বাস বা একটা পাড়া যাকে ‘ড্যানফোরথ’ এলাকা বলে, আমাদের মনের দরজায় নিঃশব্দে কান পাতুন; যেসব বাংলাদেশি এসেছি এই এলাকায়, বুঝে বা না বুঝে পরিকল্পনা করে এসেছি বা অনেকটা পরিকল্পনা ছাড়াই; এখানে এসে নিজেদের বলেছি, ‘পাসপোর্ট হয়ে গেলেই চলে যাব’, বা অনেকে বলেছি কিংবা এখনো বলে চলছি, ‘আরে ভাই, বিদেশে এসেছি তো সন্তানদের জন্য। ওরা বড় হলেই চলে যাব। এই মধ্যবয়সে এখানে এসে কী করব বলেন?’

তারপর সময় গড়িয়েছে ২০, ২৫, ৩০ বছর। বাংলাদেশে ফেরত যাওয়া তো দূরে থাক, মাত্র দুই বছর না গড়াতেই অন্যান্য ভাইবোন, জা-ননদ, বয়স্ক মা–বাবাসহ সবাইকে কী করে আনা যায়, সেই পাঁয়তারায় ব্যস্ত হয়েছি। ২০১০ সালে কত পরিবার সেই বরফকঠিন ঠান্ডার ভেতর ‘সাস্কাচুয়ান’ প্রদেশে গিয়ে পাঁচ-ছয় বছর থেকেছে কেবল পরিবারের সদস্যদের আনার জন্য, সেই ইতিহাস সিআইসির (সিটিজেনশিপ ইমিগ্রেশন কানাডা) রেকর্ডে স্পষ্ট লেখা আছে।

এই যে কানাডা বা আমেরিকায় থেকে যাওয়ার জন্য এত যুক্তি তৈরি করছি, প্রতিটা যুক্তিকে অকাট্য করে সাজাচ্ছি, তার কারণ কিন্তু একটাই। সেই অমোঘ সত্য—টাকা-ডলার মিনিমাম খেয়ে–পরে বাঁচা এবং এই সত্যের সঙ্গে লড়ে যাওয়া।

আজকের প্রথম আলোর একটা নিউজে কিছুক্ষণ চোখ আটকে ছিল; করোনাকালে বাংলাদেশে প্রবাসী রেমিট্যান্স সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এই করোনাতেই প্রবাসী বাঙালিরা সবচেয়ে বেশি টাকা পাঠাচ্ছে দেশে। টাকা কি আসলেই কথা বলে? আমার নানি বলতেন, ‘টাকায় করে কাম, হয় মরদের নাম’।

আরও পড়ুন

আজ বাংলাদেশের একটা ঘটনা শুনেছি এক বন্ধুর সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময়। ঘটনাটা এ রকম—মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক মহাখালী থেকে বাসে উঠেছেন বিকেলের দিকে। বাসে যথেষ্ট ভিড়, তবু লোকটা হাতল ধরে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে ইংরেজিতে নিজের পরিচয় দিয়ে বলছেন, ‘আমি আপনাদের ইংরেজিতে নিজের পরিচয় দিলাম শুধু এটুকু বলার জন্য, আপনারা যেন বিশ্বাস করেন যে আমি ফকির নই বা এভাবে চেয়ে চেয়ে খাই না। আমি মধ্যবিত্ত মানুষ। এই ঢাকা শহরে গত ৩২ বছর চাকরি নিয়ে সংসার চালিয়েছি। কিন্তু গত কয়েক মাসে করোনার কারণে আমার চাকরি চলে গেছে। আর কিছুতেই পেরে উঠছি না। আপনাদের যদি আমাকে বিশ্বাস হয়, আপনারা আমাকে কিছু দিয়ে হেল্প করবেন, কিন্তু দয়া করে আমাকে ফকির ভাববেন না। আমি ফকির না বা এইভাবে চলাও আমার কাজ নয়।’

সেই থেকে ভাবছি, করোনাকাল, ফেলে আসা দেশ আর দেশের মানুষ বাঁচার জন্য আর কী কী করছে? যত দিন বিদেশে আছি, যত দিন এই দেশে কাজ করে খাচ্ছি, আজকের মতো যতগুলো দিন আমার ‘পে ডে’ থাকে বা এই যে ২০ বছরের ছেলে নাইয়া মাত্র দুই দিনের জন্য বাসায় এসে যখন আমার সামনে ঘোরাঘুরি করে; যখন নিজের চোখে দেখতে পাই, ছবির মতো দেখতে পাই, কনকনে শীতের ‘অন্ধকার নিঃসঙ্গতা’ যত দিন যাচ্ছে, অক্টোপাসের মতো চারপাশ থেকে জড়িয়ে আসছে; তাও যখন স্পষ্ট বুঝতে পারি, তখন ভাবতে চেষ্টা করি, এই জীবনের বাইরে আর কোনো জীবন কি আমি বেছে নিতে পারতাম? নিঃসঙ্গতার চেয়ে কি পেটের ক্ষুধার কষ্ট বেশি?

এ প্রশ্নের উত্তর জানি না। কিন্তু বাসের লোকটা নিশ্চয়ই জানে বা যে লোক করোনাকে উপেক্ষা করে কাজে যায়, সে নিশ্চয়ই জানে বা আমার শহরে যে ছেলের চাকরি চলে যাওয়ার পর কানাডা সরকারের ইমার্জেন্সি ফান্ডের মাসিক দুই হাজার ডলার থেকে বড় অংশ বাংলাদেশে পাঠায়, সে নিশ্চয়ই উপলব্ধি করে যে তার মা-বোনেরা না খেয়ে থাকলে তার কেমন লাগবে!

ক্ষুধার কষ্ট আর নিঃসঙ্গতা—এই দুইয়ের ভেতরে কার সঙ্গে লড়ে যাওয়া উচিত মানুষের, আমরা সবাই কি স্পষ্ট করে উত্তর জানি?

২ অক্টোবর ২০২০

টরন্টো, কানাডা