কেন বর্তমান প্রজন্ম বই থেকে দূরে সরে যাচ্ছে

বর্তমানে সবকিছু কাছে থাকলেও বই পড়ার অভ্যাসটা যেন হারিয়ে যাচ্ছে কোনো অদৃশ্য আড়ালেছবি: প্রথম আলো

আমার চাচ্চু হুমায়ূন আহমেদের ভক্ত ছিলেন। ছোটবেলা থেকে দেখতাম, তিনি অসংখ্য বই পড়তেন। তাঁর হাতেই প্রথম বই দেখেছি, বইয়ের পাতার গন্ধ চিনেছি। সেখান থেকেই বইয়ের প্রতি টান জন্মেছিল। স্কুলজীবনে সেই টান ধীরে ধীরে নেশায় রূপ নেয়।

একটা সময় ছিল, প্রতিদিন বই কিনতাম। হুমায়ূন আহমেদ, সমরেশ মজুমদার, জাফর ইকবাল—তাঁদের বইয়ে ডুবে থাকা ছিল বেড়ে ওঠার রুটিনের অংশ। বাসায়, রাস্তায়, স্কুলের ক্লাসের কর্নারে—কোথাও না কোথাও বইয়ে মুখ গুঁজে থাকতাম।

স্বপ্নও গড়ে উঠেছিল বইকে কেন্দ্র করে। চেয়েছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে। কারণ, এর চারপাশেই বইয়ের স্বর্গরাজ্য—বাংলা একাডেমি, নীলক্ষেত, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, পাঠক সমাবেশ, আজিজ মার্কেট, বাংলাবাজার। ২০১৮ সালে একদিন বায়না ধরে কেঁদেকেটে দাদুকে রাজি করিয়ে বাংলাবাজার থেকে এক বস্তা বই কিনে এনেছিলাম। মনে হয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে বইয়ের সান্নিধ্য আরও বাড়বে। কিন্তু আজ সবকিছু কাছে থাকলেও বই পড়ার অভ্যাসটা যেন হারিয়ে যাচ্ছে কোনো অদৃশ্য আড়ালে।

পাঠক মানেই সমাজের মেরুদণ্ড। যারা পড়ে, তারাই ভাবে। যারা ভাবে, তারাই প্রশ্ন তোলে, প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

প্রধান একটি কারণ হলো বইয়ের দাম। সাধারণ তরুণের নাগালের বাইরে চলে গেছে। আগে যে উপন্যাস দুই-তিন শ টাকায় পাওয়া যেত, এখন তা ছয়-সাত শ টাকা। মোটা একটি বই কিনতে গেলে হাজার টাকার কাছাকাছি গুনতে হয়। আমাদের মতো শিক্ষার্থীদের পক্ষে নিয়মিত বই কেনা আর সম্ভব হয় না। ফলে বই পড়া আগ্রহ নয়, বিলাসিতা হয়ে উঠেছে। অথচ একসময় ঈদের সালামি জমিয়েই বই কিনে ফেলতাম।

সঙ্গে যোগ হয়েছে একাডেমিক চাপে ডুবে থাকা জীবন। ক্লাস, ক্লাস টেস্ট, অ্যাসাইনমেন্ট, কুইজ, সেশনজট—এসবের ভিড়ে সাহিত্য পড়া তো দূরের কথা, নিজের মতো করে নিশ্বাস নিতেই কষ্ট হয়। লাইব্রেরিতে ঢুকলেই দেখা যায়, ভোর থেকে লাইন—সবাই চাকরির পড়ায় ব্যস্ত। বিসিএস, ব্যাংক, সরকারি চাকরি—এসবই এখন জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। সাহিত্য যেন অচেনা এক অবকাশে পরিণত হয়েছে।

আরেকটি বড় কারণ, যাঁরা একসময় পাঠক গড়ে তুলেছিলেন, সেই লেখকদের অনেকেই এখন প্রশ্নবিদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ, ক্ষমতাবানদের দোসর হওয়া কিংবা ফ্যাসিবাদের সহযোগী হয়ে ওঠার অভিযোগে একাংশ লেখক তরুণদের কাছে আর গ্রহণযোগ্য নন। বিশেষ করে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর একটি প্রজন্ম সচেতনভাবে তাঁদের বয়কট করছে। এর প্রভাব পড়েছে বই পড়ার সংস্কৃতিতে। পুরোনো লেখকদের বর্জনের পর নতুন পাঠক তৈরির প্রক্রিয়াও দুর্বল হয়ে গেছে।

আরও পড়ুন

শিশু-কিশোরদের পড়ার পরিবেশও সংকুচিত। আশপাশে কেউ বই পড়ে না। মা–বাবা, আত্মীয়স্বজন, বড় ভাইবোন বইয়ের প্রতি অনাগ্রহী হলে নতুন প্রজন্ম শিখবে কাকে অনুসরণ করে? পড়ার প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয় অনুকরণের মাধ্যমে। পরিবেশ না থাকলে সেই ভালোবাসা জন্ম নেবে কীভাবে?

সমাজে বই পড়াকে এখনো অনেক সময় নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। স্কুলে প্রচুর বই পড়তাম বলে শুনতে হতো—‘এত বই পড়লে নাস্তিক হয়ে যাবা।’ আবার বলা হতো, ‘বাইরের বই পড়লে পড়াশোনায় মন থাকবে না, ভালো রেজাল্ট হবে না।’ এমন ভীতি ছড়িয়ে তরুণদের নিরুৎসাহিত করা হয়। ফলে যারা বই পড়তে চায়, তারাও পিছিয়ে যায়।

পাঠাগারগুলোতেও চলছে সেন্সরশিপ। যে বইগুলো একসময় নতুন পাঠক তৈরি করেছে—হুমায়ূন আহমেদ, জাফর ইকবাল, কিংবা কিশোরদের প্রিয় ‘তিন গোয়েন্দা’—এসব বই নানা অজুহাতে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কখনো ধর্মীয়, কখনো আদর্শগত কারণ দেখিয়ে বলা হয়—‘ওপরের নিষেধ আছে।’ অথচ এগুলোই ছিল তরুণদের পাঠাভ্যাসের প্রধান সোপান।

যে জাতি পাঠক হারায়, সে জাতি একসময় স্বপ্নও হারায়। এখনই সময় বইকে ফিরিয়ে আনার, পাঠকদের পাশে দাঁড়ানোর
ছবি: লেখক

তরুণদের পড়ার ধরনও বদলে গেছে। আজ তারা বেশি টানছে প্রেম, অবসাদ, নিঃসঙ্গতা বা হৃদয় ভাঙার গল্পের দিকে। মৌরি মরিয়ম কিংবা সাদাত হোসেনের উপন্যাস তাদের আবেগময় জগতে ডুবিয়ে রাখছে। কিন্তু যে পাঠাভ্যাস মানুষকে বিশ্লেষণী ও সংবেদনশীল করে তুলত, এখন তা দুর্বল আবেগের ভেলায় ভাসিয়ে নিচ্ছে।

আমি নিজেও টের পাই, বই থেকে দূরে সরে গিয়ে যেন নিজের কাছ থেকেই হারিয়ে যাচ্ছি। ভয় হয়—আমার মতো করে যদি একদিন পুরো একটি প্রজন্ম বই হারিয়ে ফেলে, তাহলে দেশ হারাবে তার পাঠক, হারাবে চিন্তাশীল মানুষ। কারণ, পাঠক মানেই সমাজের মেরুদণ্ড। যারা পড়ে, তারাই ভাবে। যারা ভাবে, তারাই প্রশ্ন তোলে, প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু বইবিহীন প্রজন্ম কেবল স্ক্রল করতে জানে, চিন্তা করতে জানে না। তারা সহজে উত্তেজিত হয়, কিন্তু বিশ্লেষণ করতে শেখে না।

এ অবস্থা চলতে থাকলে পাঠ্যহীনতা কেবল ব্যক্তিগত ক্ষয় নয়, সমাজের জন্যও বিরাট ক্ষতি হয়ে দাঁড়াবে। যে জাতি পাঠক হারায়, সে জাতি একসময় স্বপ্নও হারায়। এখনই সময় বইকে ফিরিয়ে আনার, পাঠকদের পাশে দাঁড়ানোর।

বই পড়া নাস্তিকতা নয়, উন্নত মানবিকতার প্রতীক—এই উপলব্ধি সমাজে ছড়িয়ে দিতে হবে। একাডেমিক পড়ার বাইরে ‘অন্যান্য বই’ পড়াকেও উৎসাহ দিতে হবে। না হলে আগামী প্রজন্ম হয়তো বই শব্দটাই ভুলে যাবে। তখন কেবল স্মৃতির ভেতরই খুঁজতে হবে বইয়ের গন্ধ, পাতা ওল্টানোর শব্দ আর পাঠকের ভিড়ে ঠাসা মেলার দৃশ্য।

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ‍্যালয়