ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর—যে সৌন্দর্য ফিরবে না আর

অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের পর নৌকায় করে নেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর এলাকার প্রবেশমুখেছবি: আনিস মাহমুদ

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে ভোলাগঞ্জের সাম্প্রতিক কিছু ছবি ও ভিডিও। দৃশ্যগুলো এমন, মন যেন মুহূর্তেই হাহাকার করে ওঠে। যেখানে একসময় ছিল দুধ-সাদাপাথরের অসীম ভান্ডার, সেখানে এখন ফাঁকা নদীতল ছাড়া কিছুই নেই। পাহাড়ি জলধারা আর পাথরের মিলনে গড়ে ওঠা সেই স্বর্গীয় দৃশ্য চোখের সামনে উধাও হয়ে গেছে। বলা হচ্ছে, অবৈধ উত্তোলনের ভয়াবহ দৌরাত্ম্যে গত কয়েক মাসেই এই ধ্বংস সম্পূর্ণ হয়েছে।

ভোলাগঞ্জ আমার জন্য শুধু একটি ভ্রমণস্থান ছিল না, ছিল একধরনের ব্যক্তিগত আশ্রয়। প্রথমবার সেখানে যাই ২০২০ সালের জানুয়ারিতে। শীতের নীল আকাশের নিচে মেঘালয়ের পাহাড় ছুঁয়ে আসা ঠান্ডা পানিতে বসে, চারপাশে ছড়িয়ে থাকা সাদাপাথরের ভুবনে যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম। চারপাশে ছিল পানির মৃদু শব্দ আর পাহাড়ের নীরবতা। সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, প্রকৃতি আমাকে তার বুকের খুব কাছে টেনে নিয়েছে। দ্বিতীয়বার যাই ২০২২ সালে, নিজেকে খুঁজে পাই ঠিক আগের জায়গাতেই। একা পানিতে বসে মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে, পাথরের উজ্জ্বলতায় চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়া সেই একই অনুভূতিতে ডুবে যাই। তখনো মনে হয়নি, এত তাড়াতাড়ি সেই দৃশ্য চিরতরে হারিয়ে যাবে।

এখনকার ছবিগুলো দেখে বুঝতে পারছি, সেই সৌন্দর্য আর কখনো ফিরবে না। সাদাপাথরের স্তূপ, স্বচ্ছ পানির তলদেশে ঝলমল করা প্রাকৃতিক আভা—সবই এখন অতীত। পাথর শুধু চোখের আনন্দই ছিল না, বরং নদীর তলদেশকে স্থিতিশীল রাখত, পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করত, আর তীরভাঙন ঠেকাত। অতিরিক্ত উত্তোলনের ফলে এখন নদীর গভীরতা বেড়ে যাবে, তলদেশে কাদা জমছে, জলজ প্রাণীরা হারিয়ে যাবে।

এখন বড় পাথর প্রায় নেই বললেই চলে। দিন ও রাতের আঁধারে কয়েক হাজার মানুষ এসব পাথর তুলে নিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর এলাকায়
ছবি: আনিস মাহমুদ

প্রশাসন মাঝেমধ্যে অভিযান চালালেও তা ছিল সাময়িক। অপরাধীরা রাজনৈতিক প্রভাবের ছত্রচ্ছায়ায় বারবার ফিরে এসেছে। আর একসময়কার প্রাকৃতিক বিস্ময় এখন রূপ নিয়েছে এক বিরান প্রান্তরে। পর্যটনও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে; যে জায়গায় একসময় হাজারো মানুষ ছবি তুলতে ভিড় করত, আগামী দিনগুলোতে সেখানে হয়তো থাকবে নিঃসঙ্গ নীরবতা।

জানি, আর কোনো দিন হয়তো ভোলাগঞ্জে গিয়ে সাদাপাথরের ওপর বসে মেঘালয়ের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারব না। সেই দৃশ্য, সেই নীরবতা, সেই অনুভূতি—সবকিছুই এখন কেবল স্মৃতি হয়ে থাকবে। প্রকৃতি আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিল এক অনন্য উপহার, আর আমরা নিজের হাতে সেটিকে শেষ করে ফেললাম।

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়