নবজাতকের জন্ডিস: সূর্যের আলোতে রাখলেই কি ভালো হয়

প্রতীকীছবি: ফ্রিপিক

২৮ বছর বয়সী সাদিয়া (ছদ্মনাম), স্বাভাবিক প্রসবের মাধ্যমে একটি পরিণত ফুটফুটে পুত্রসন্তান জন্ম দেন। সাদিয়ার রক্তের গ্রুপ ও পজিটিভ। জন্মের দ্বিতীয় দিন নবজাতকের জন্ডিস দেখা দেয়। আত্মীয়স্বজন ও মুরব্বিরা প্রচলিত নিয়মে নবজাতককে সরাসরি সূর্যের আলোয় রাখতে বলেন। কিন্তু দিন দিন তার জন্ডিস বাড়তে থাকে এবং পরবর্তী সময় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে অন্যান্য সেবার সঙ্গে নবজাতকের রক্ত পরিবর্তন করা হয়। প্রাণে বেঁচে গেলেও সে প্রতিবন্ধী হয়ে যায়, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।

নবজাতকের জন্ডিস কী ও কেন হয়
জন্মের পর নবজাতকের শরীরে বিলিরুবিন নামে একটি পদার্থ জমে গিয়ে চোখ ও শরীর হলদে দেখায়, এটাই জন্ডিস। সাধারণত জন্মের পর প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৭ জন নবজাতকের এই জন্ডিস হয়ে থাকে। পূর্ণমেয়াদি নবজাতকের ক্ষেত্রে ৪৮ ঘণ্টা পর জন্ডিস দেখা দিতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এটি স্বাভাবিক এবং কিছুদিন পর নিজে থেকেই সেরে যায়। এতে সাধারণত কোনো চিকিৎসা লাগে না।

বড়দের তুলনায় শিশুদের শরীরে লোহিত রক্তকণিকা বেশি থাকে এবং তা দ্রুত ভেঙে যায়। ফলে তার শরীরে বেশি পরিমাণ বিলিরুবিন তৈরি হয়। জন্মের পর নবজাতকের লিভার অপরিপক্ব থাকার কারণে সে অতিরিক্ত বিলিরুবিন পুরোপুরি বের করতে পারে না। তখন বিলিরুবিন জমে শরীরের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হলদেটে ভাব দেখায়।

নবজাতকের জন্ডিসের স্বাভাবিক মাত্রা সাধারণত বয়স, ওজন, শারীরিক অবস্থা ও অন্যান্য কারণের ওপর নির্ভর করে।

কখন নবজাতকের জন্ডিস ঝুঁকিপূর্ণ
* জন্মের সময় রক্তের গ্রুপের অসামঞ্জস্যতা, যেমন মায়ের রক্তের গ্রুপ ও পজিটিভ হয় এবং শিশুর রক্তের গ্রুপ এ পজিটিভ বা বি পজিটিভ হয়।
* মায়ের রক্তের গ্রুপ আরএইচ নেগেটিভ হয় এবং তার শিশুর রক্ত আরএইচ পজিটিভ হয়।
* অপরিণত বা কম ওজনের শিশু।
* জন্মের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জন্ডিস।
* অসুস্থ নবজাতকের জন্ডিস।

এসব ক্ষেত্রে জন্ডিস খুব দ্রুত বাড়ে, বিলিরুবিনের মাত্রা খুব বেশি হয় এবং বিপজ্জনক হতে পারে। শিশুর মধ্যে ঘন ঘন ঘুম, খাওয়ায় অনীহা, নিস্তেজতা, খিঁচুনি ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। তাই সতর্কতা খুবই জরুরি।

জন্ডিসের কী কী লক্ষণ বিপজ্জনক ও ইমার্জেন্সি
কিছু কিছু লক্ষণ বিপজ্জনক, যেগুলো সব সময় খেয়াল রাখতে হবে। যেমন:
১. চোখ, মুখ, বুক হলুদের সঙ্গে যদি হাতের তালু, পায়ের তালুও হলুদ হয়ে যায়।
২. ১৪ দিনের বেশি সময় ধরে শিশুর চোখ, মুখ, বুক হলুদ থাকা।
৩. জন্ডিসে আক্রান্ত শিশুর পায়খানার রং যদি হলুদ না হয়ে সাদা হয়।

ওপরের যেকোনো লক্ষণ মিলে গেলেই যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

আরও পড়ুন

কীভাবে বোঝা যাবে এবং কখন শিশুর জন্ডিসের পরীক্ষা করতে হয়
যদি শিশুর মুখমণ্ডল হলুদ রঙের মনে হয়, প্রথম দিনেই রক্ত পরীক্ষা করতে হবে। তার মুখ ও বুক যেকোনো দিন হলুদ দেখা গেলে সে ক্ষেত্রেও রক্ত পরীক্ষা করতে হবে।

যদি শিশুর শরীরের নিম্নভাগ হাত ও পা পর্যন্ত হলুদভাব নেমে আসে; যদি জন্মের দুই-তিন দিনের মধ্যেই খুব বেশি হলুদ হয়ে যায়, তবে এটি গুরুতর হতে পারে। যদি পরিবারের আগের শিশুরা জন্ডিসের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়ে থাকে, তাহলে নতুন শিশুর ক্ষেত্রেও একই ঝুঁকি থাকতে পারে। মায়ের ডায়াবেটিসের সমস্যা থাকলেও শিশুর জন্ডিস হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।

কী কী উপায়ে জন্ডিস পরীক্ষা করা যায়
নবজাতকের জন্ডিস পরীক্ষা করার কয়েকটি পদ্ধতি আছে-
১. চোখে দেখে: ডাক্তার যদি মনে করেন যে শিশুকে দেখে হলুদ লাগছে; তখন চোখ, মুখ, বুকের ওপর হালকা চাপ দিয়ে, হাত, পায়ের তলা দেখে পরীক্ষা করতে পারেন।
২. রক্ত পরীক্ষা: শিশুর শরীর থেকে অল্প কিছু রক্ত নিয়ে ল্যাবে পরীক্ষা করা হয় ও রেজাল্ট দেখে জানা যায় তার জন্ডিসের মাত্রা কত।

শিশুর জন্ডিসের চিকিৎসা কেন জরুরি
বিলিরুবিন একটি নির্দিষ্ট লেভেলের ওপর চলে গেলে তখন সেটা শিশুর ব্রেনের পর্দা ভেদ করে মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে, যা তার জন্য খুব ক্ষতিকর। তাই জন্ডিসের ধরন নির্ণয় করে উপযুক্ত চিকিৎসা নিতে হবে।

কীভাবে জন্ডিসের চিকিৎসা করতে হয়
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জন্ডিসের চিকিৎসায় শিশুকে রোদে দেওয়া সর্মথন করে না। বেশিক্ষণ বা প্রখর রোদে রাখলে শিশুর সানবার্ন বা রোদে পুড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

তবে কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, জন্ডিসের চিকিৎসায় শিশুকে কাচের আবরনের মাধ্যমে কিছু সময় রোদে রেখে দিলে উপকার পাওয়া যেতে পারে। সূর্যের আলো ভিটামিন ডি–এর ভালো উৎস, যা শিশুর জন্য বেশ উপকারী।
১. মায়ের বুকের দুধ: সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শিশুকে ঘন ঘন বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। কারণ, জন্ডিস হলে শিশুর শরীরে পানি/ ফ্লুইড কমে ডিহাইড্রেশন হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
২. রোদ লাগানো: প্রতিদিন সকালে রোদে শিশুকে ২০ থেকে ৩০ মিনিট রাখতে হবে। তার চোখ মুখ ও লজ্জাস্থান আড়াল করে বাকি শরীর যত বেশি উন্মুক্ত রাখা যায়।
৩. ফটোথেরাপি: এটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে দিতে হবে। নীল আলোর নিচে শিশুকে রাখা হয়, চোখ আর লজ্জাস্থান ঢেকে রেখে। নীল আলোতে রাখলে সেটা শিশুর বিলিরুবিনকে ভেঙে ফেলতে পারবে এবং সেটি তার পায়খানা ও প্রস্রাবের সঙ্গে বের হয়ে যাবে। ফলস্বরূপ জন্ডিস সেরে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এই ফটোথেরাপি দেওয়াকে সর্মথন করে।
৪. রক্ত পরিবর্তন: জন্ডিস অনেক বেশি হলে শিশুর রক্ত পরিবর্তনের প্রয়োজন হতে পারে।

জন্ডিসে যা কখনোই করণীয় নয়
আমাদের দেশে গ্রামে ও শহরে জন্ডিসের চিকিৎসায় নানা রকম ঘরোয়া/কবিরাজি চিকিৎসা, যেমন শিশুকে ছাল–বাকলের রস খাওয়ানো, ঝাড়ফুঁক, পানিপড়া, গ্লুকোজের পানি, কৌটার দুধ, গোসল, মায়ের জন্য নিয়মকানুন প্রচলিত আছে, যা ভালোর চেয়ে মন্দই করে বেশি। তাই শিশুর জন্ডিসের চিকিৎসায় এসব ভুল পদ্ধতি প্রয়োগ না করে চিকিৎসকের পরামর্শমতো চিকিৎসা নিতে হবে।

পরিশেষে বলা যায়, নবজাতকের জন্ডিস সাধারণত কোনো ভয়ের বিষয় নয়। বেশির ভাগ জন্ডিস চিকিৎসা ছাড়াই ভালো হয়ে যায়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটি মারাত্মক হতে পারে। নবজাতকের জন্ডিস হলে আতঙ্কিত না হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শমতো চিকিৎসা নিতে হবে। সঠিক চিকিৎসায় জন্ডিস সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য।

লেখক: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, নবজাতক বিভাগ, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।