শেখার মূলমন্ত্র: কৌতূহল থেকে কৌশল

মনোযোগ বাড়াতে বই পড়া একটা ভালো অভ্যাসছবি: প্রথম আলো

শিক্ষা ও শেখার যাত্রা শুধু বিদ্যালয় বা পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। জীবন আমাদের কাছে প্রতিনিয়ত নতুন কিছু শেখায়। প্রকৃতি, মানুষ, চ্যালেঞ্জ এবং নিজেদের সীমাবদ্ধতাকে চিনতে শিখাই শেখার প্রকৃত রূপ। কেউ কেউ হয়তো মনে করেন, শিক্ষার অর্থ হলো তথ্য অর্জন করা, কিন্তু প্রকৃত শিক্ষা মানে হলো জ্ঞানকে অভিজ্ঞতায় রূপান্তর করা, ব্যর্থতাকে গ্রহণ করা এবং নিজের মনকে সদা প্রগতিশীল রাখা। নিচে উল্লেখ করা এই ১০টি মূলমন্ত্র শেখার পথকে সহজ, প্রেরণামূলক ও ফলপ্রসূ করে তোলে। এগুলো শুধু পড়াশোনার জন্য নয়, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

শেখার ১০ মূলমন্ত্র
১. কৌতূহলের প্রদীপ জ্বালাও: ‘গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রশ্ন করা থামিয়ে না দেওয়া। কৌতূহলের নিজের অস্তিত্বেরও একটি বিশেষ কারণ আছে।’— আলবার্ট আইনস্টাইন

আলবার্ট আইনস্টাইন তাঁর আবিষ্কারের মূল রহস্য হিসেবে কৌতূহলকেই দায়ী করেছেন। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি শৈশব থেকে পাখির ডানা, পানির স্রোত, মানবদেহ—সবকিছু নিয়েই প্রশ্ন করতেন। সেই কৌতূহলই তাঁকে একসঙ্গে শিল্পী ও বিজ্ঞানী বানায়। প্রতিটি নতুন বিষয়কে বিস্ময়ের চোখে দেখলে শেখা হয়ে ওঠে এক রোমাঞ্চকর অভিযান।

২. লক্ষ্যকে নক্ষত্রের মতো স্থির করো: ‘চাঁদকে লক্ষ করো। মিস করলেও তারার ভেতরেই গিয়ে পৌঁছাবে।’— নরম্যান ভিনসেন্ট পিল

মালালা ইউসুফজাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মেয়েদের শিক্ষার অধিকার রক্ষায় অটল ছিলেন। তাঁর লক্ষ্য সুস্পষ্ট ছিল—শিক্ষাবঞ্চিত কোনো মেয়ে যেন না থাকে। শেখার উদ্দেশ্য যদি পরিষ্কার হয়, তবে প্রতিকূলতার পথেও হারিয়ে যাওয়ার ভয় থাকে না।

৩. ক্ষুদ্র পদক্ষেপে মহাসফর শুরু করো: ‘হাজার মাইলের যাত্রা শুরু হয় একটিমাত্র পদক্ষেপ দিয়ে।’— লাও তজু

স্টিভ জবস প্রথমে গ্যারেজে বসে ছোট ছোট পরীক্ষার মাধ্যমে অ্যাপলের যাত্রা শুরু করেছিলেন। শেখার ক্ষেত্রেও বড় লক্ষ্য পূরণের জন্য ছোট ছোট অংশে এগোতে হয়। ধাপে ধাপে অগ্রসর হওয়াই স্থায়ী সাফল্য এনে দেয়।

৪. শেখাকে খেলার মতো উপভোগ করো: ‘খেলাই হলো গবেষণার সর্বোচ্চ রূপ।’— আলবার্ট আইনস্টাইন

ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থায় শেখাকে আনন্দমুখর করতে গেম, সৃজনশীল কার্যক্রম ও প্রকল্পভিত্তিক শিক্ষা ব্যবহার করা হয়। আনন্দের রঙে রাঙানো শেখা দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং মনকে ক্লান্ত করে না।

আরও পড়ুন

৫. অনুশীলনের বীজ রোপণ করো: ‘অভ্যাস এমন কিছু নয়, যা তুমি ভালো হয়ে যাওয়ার পর করো। বরং অভ্যাসই হলো সেই কাজ, যা তোমাকে ভালো করে তোলে।’— ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েল

বিখ্যাত বেহালাবাদক ইটজাক পার্লম্যান প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনুশীলন করতেন, এমনকি অসুস্থ থাকলেও থামতেন না। শেখা কেবল তত্ত্বে সীমাবদ্ধ থাকলে বৃথা হয়; প্রতিদিনের অনুশীলনই জ্ঞানের মজবুত শিকড় গড়ে তোলে।

৬. ভুলকে শিক্ষক হিসেবে গ্রহণ করো: ‘ব্যর্থতা আসলে আবার শুরু করার একটি সুযোগ, তবে এবার আরও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে।’— হেনরি ফোর্ড

থমাস এডিসন বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কারের পথে হাজারো ব্যর্থতা দেখেছিলেন, কিন্তু প্রতিটি ভুল থেকে নতুন কিছু শিখে এগিয়েছিলেন। ভুল আমাদের শেখার গোপন পাঠ্যপুস্তক।

৭. বৈচিত্র্যের স্রোতে নিজেকে ভাসাও: ‘তুমি যত বেশি পড়বে, তত বেশি জানবে। তুমি যত বেশি শিখবে, তত দূরদূরান্তে যেতে পারবে।’— ডক্টর সিউস

ইলন মাস্ক পদার্থবিদ্যা থেকে প্রোগ্রামিং, ব্যবসা থেকে রকেট প্রযুক্তি—নানা বিষয়ে শিখেছেন। বিভিন্ন উৎস, সংস্কৃতি ও পদ্ধতি থেকে শেখা মনকে প্রশস্ত করে এবং সমস্যার সমাধানে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেয়।

৮. মনোযোগের বাগান পরিচর্যা করো: ‘যখন তোমার কল্পনা অস্পষ্ট, তখন চোখের ওপর নির্ভর করা যায় না।’— মার্ক টোয়েন

বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ধ্যানের মাধ্যমে মনোযোগ ধরে রাখার কৌশল শেখেন। যা তাঁদের গভীর জ্ঞানার্জনে সহায়তা করে। শেখার সময় নির্দিষ্ট পরিবেশ, নীরবতা ও একাগ্রতা মনকে পাঠ গ্রহণের জন্য প্রস্তুত করে।

৯. নিজেকে অনুপ্রাণিত করো: ‘প্রেরণা হলো যেটি তোমাকে শুরু করতে প্ররোচিত করে। অভ্যাস হলো যেটি তোমাকে চালিয়ে যেতে সাহায্য করে।’— জিম রায়ান

ওপ্রাহ উইনফ্রে দারিদ্র্য ও প্রতিকূলতার মধ্যেও শিক্ষা ও উন্নতির জন্য প্রেরণা ধরে রেখেছিলেন। প্রতিদিন নিজের শেখার কারণ মনে করিয়ে দেওয়া প্রেরণাকে জীবন্ত রাখে।

১০. শিক্ষা ভাগ করে আলো ছড়াও: ‘যদি তুমি কোনো কিছুকে দক্ষতার সঙ্গে আয়ত্ত করতে চাও, তবে সেটি শেখাও।’— যোগী ভাজান

আইজ্যাক নিউটন তাঁর আবিষ্কার ও তত্ত্বগুলো কেবল নিজের জন্য রাখেননি; তিনি শিক্ষা দিয়েছেন এবং লিখেছেন, যাতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম উপকৃত হয়। জ্ঞান ভাগ করলে তা শুধু বাড়ে না, বরং অন্যের জীবনেও আলো জ্বালায়।

সদস্য, সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা