শিউলি ফুল সম্পর্কে কতটা জানেন
আশ্বিন-কার্তিক এ সময়ে প্রকৃতি খুব কোমল, উদার আর স্নিগ্ধ। শরৎ আর হেমন্তের ভোর এত মোহময় যেন মনে হয় শিল্পীর তুলিতে আঁকা সকাল। আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার। বাতাসে শীতের মৃদু আরামদায়ক স্পর্শ। ভাসা–ভাসা মেঘ আর কাশফুলের দোলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাতাসে মিশে থাকে চমৎকার একটি ফুলের গন্ধ। এই ফুলের মিষ্টি সুবাস হালকা শীতল বাতাসকে করে তোলে আরও উপভোগ্য। এই ফুল সন্ধ্যার পর ফোটে আর সূর্য ওঠার আগেই ডুবে যায়। সূর্য ওঠার আগেই চিরদুঃখী সুন্দরী ফুল অভিমান করে ঝরে পড়ে। তাই একে বলে ‘নিশি বিষাদিনী’।
বৈজ্ঞানিক তথ্য
বলছি শরতের রানি শিউলির কথা। শিউলি অর্থ শেফালিকা ফুল বা গাছ। এর বৈজ্ঞানিক নাম ‘নিকট্যানথিস আর্বর–ট্রিস্টিস’লাতিন ভাষায় নিকট্যানথিস মানে ‘সন্ধ্যায় ফোটা’, এবং আর্বর-ট্রিস্টিস মানে ‘বিষণ্ন গাছ’।
দিনে ফুলগুলো তাদের উজ্জ্বলতা হারায় এবং সকালে সূর্য ওঠার আগেই ঝরে পড়ে, যা একধরনের বিষণ্নতা বা দুঃখের প্রতীক। এ কারণে একে ‘দুঃখের বৃক্ষ’ বা ‘বিষণ্ন গাছ’ও বলা হয়। অনেকের কাছে এটি ‘রাতের রানি’ নামে পরিচিত। শিউলি ফুল শরৎকালের এক মন ভোলানো ফুল, যা রাতে ফুটে সকালে ঝরে যায় এবং শিশির ভেজা সকালে এক অপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি করে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রেম, ত্যাগ ও পবিত্রতার প্রতীকী আখ্যান। শরতে ফুটলেও হেমন্তকে বঞ্চিত করে না শিউলি। হেমন্তের রূপেও জড়িয়ে থাকে এটির স্নিগ্ধতা।
ফুল ফোটা ক্রমেই কমে এলেও কার্তিকের শেষ পর্যন্ত দেখা পাওয়া যায় শিউলির। কোনো কোনো গাছে সারা বছরই ফুল হয়!
শিউলি কোমল সাদা রঙের ছোট ছোট ফুল, দুধসাদা রঙের মাঝখানে জাফরান রঙের ফোঁটা, বোঁটাও জাফরানি। ভোরে গাছের নিচটা ভরে যায় ফুলে, আর কোমল গন্ধে ভরে ওঠে চারদিক। নরম ও ধূসর বাকলবিশিষ্ট এই গাছ ১০ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। মিষ্টি–সুগন্ধিজাতীয় এই ফুলে রয়েছে পাঁচ থেকে সাতটি সাদা পাপড়ি ও মাঝখানে লালচে-কমলা টিউবের মতো বৃন্ত।
শিউলি ফুলের কলি মুখ তুলে চায় সন্ধ্যায়। বেলা ডোবার পর থেকে ধীরে ধীরে ফুটতে থাকে। ততক্ষণে চারধারে আঁধার নেমে এলেও বাতাসে ভেসে আসা মিষ্টি সুবাস জানিয়ে দেয় এর অস্তিত্ব। শেষ রাতে শিউলির সুবাস ছড়িয়ে পড়ে বহুদূর পর্যন্ত। এ জন্য এর ইংরেজি নাম ‘নাইট জেসমিন’, আর হিন্দি ও উর্দুতে একে ডাকা হয় ‘রাতকা রানি’। বাংলাদেশি প্রকৃতিবিদ ও জীববিজ্ঞানী দ্বিজেন শর্মা শিউলি বন্দনায় বলেছেন, ‘কোনো বাগানই পূর্ণতা পায় না শিউলি না থাকে যদি।’
পৌরাণিক ও সাহিত্যিক কাহিনি
শিউলি নিয়ে আছে গ্রিক উপাখ্যান। সূর্যের প্রতারিত স্ত্রী শিউলি। সূর্যদেব সুন্দরী শিউলিতে তৃপ্ত না হয়ে অন্য নারীতে আসক্ত হলে শিউলি প্রচণ্ড ঘৃণায় তাকে ত্যাগ করেন। সূর্যের স্ত্রী হয়েও তিনি চিরদুঃখী। তাই এর নাম ‘নিশি বিষাদিনী’। তাই গভীর অভিমানে শিউলি সূর্য ওঠার আগেই ঝরে পড়ে।
হিন্দু ধর্মমতে, শিউলি স্বর্গের ফুল। হিন্দু পুরাণে অবশ্য শিউলির পরিচিতি ‘পারিজাত’ নামে। পৌরাণিক কাহিনিতে বারবার এসেছে পারিজাত ফুলের কথা। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, বেদনার প্রতীক স্বল্পায়ুর এ ফুল। এর সূচনার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক ব্যর্থ প্রেমের করুণ গল্প।
গল্পটি এমন, নাগরাজের অপরূপা লাবণ্যময়ী কন্যা পারিজাতিকা সূর্যের প্রেমে পড়েন। কিন্তু সূর্যের সঙ্গে মিলন হওয়ার নয় বলে সে মনের দুঃখে আত্মহত্যা করে। সেই রাজকন্যা পারিজাতিকার চিতাভস্ম থেকে জন্ম নেয় শিউলি ফুলের গাছ। তাই শিউলি ফুলের আরেক নাম পারিজাত। পারিজাত মনের দুঃখে–ক্ষোভে সূর্যের মুখ দেখতে চায় না বলেই সকালবেলায় সূর্য ওঠার আগেই ঝরে পড়ে গাছ থেকে। সূর্যের স্পর্শমাত্রই সে নীরব ব্যর্থ প্রেমিকার মতো ঝরে পড়ে মাটিতে। এই পারিজাত হলো স্বর্গের শ্রেষ্ঠ কুসুম।
পুষ্পপুরাণে রয়েছে অন্য গল্প। পারিজাত হলো স্বর্গের ফুল। পারিজাতের বাস ছিল স্বর্গে। পারিজাত স্বর্গে শোভা হয়ে নিজের ঘ্রাণে মুগ্ধ করত দেব-দেবীদের।
কৃষ্ণের দুই স্ত্রী—সত্যভামা ও রুক্মিণীর খুব ইচ্ছে, তাদের বাগানও পারিজাতের ঘ্রাণে আমোদিত হোক। স্ত্রীরা পরীক্ষা করতে চাইল, কৃষ্ণ কাকে বেশি ভালোবাসে—সত্যভামা নাকি রুক্মিনীকে। কৃষ্ণ উদাসীন থাকেন এ প্রশ্নে।
একদিন কৃষ্ণ স্ত্রীদের খুশি করতে লুকিয়ে স্বর্গের পারিজাত বৃক্ষ থেকে একটি ডাল ভেঙে এনে সত্যভামার বাগানে রোপণ করেন। এর ফুল রুক্মিণীর বাগানেও ঝরে পড়ে সুগন্ধ ছড়ায়।
এদিকে স্বর্গের রাজা দেবরাজ ইন্দ্র ঘটনাটা জেনে খুব রেগে যান। তিনি কৃষ্ণকে শাপ দেন কৃষ্ণের বাগানের পারিজাত বৃক্ষ ফুল দেবে ঠিকই, কিন্তু ফল কোনো দিন আসবে না, বীজে কখনো নতুন প্রাণের সঞ্চার হবে না।
শিউলির ফল যেমন হয়
শিউলির ফল চ্যাপ্টা হৃৎপিণ্ডাকৃতির। ফলটি দুই ভাগে বিভক্ত। প্রতিটি ভাগে একটি করে বীজ থাকে। বীজ থেকে চারা তৈরি করা যায়, আবার গুটিকলমেও বিস্তার সম্ভব।
ছোটবেলা থেকে শুরু করে বড় হয়েও এই ফুলের স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছি প্রতিনিয়ত। ছোটবেলার এই ফুলের মালা গেঁথেছি কত! এটি এমন এক মোহ, যা বড় হয়েও কাটে না। স্নাতকে পড়াকালীন বন্ধুদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল শিউলি কুড়ানো নিয়ে। ঘুম ঘুম চোখের সকালটা শুরু হতো শিউলির তাজা গন্ধ রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকিয়ে। ক্লাসে টেবিলে বইয়ের ওপর থাকত শিউলির স্তূপ। মনে হতো শিউলি যেন মায়ের স্নিগ্ধতার প্রতীক!
কবি-সাহিত্যিকদের লেখায় শিউলি ফুল
আবহমান বাংলার চিরচেনা শিউলি ফুল নিয়ে সেই পৌরাণিক কাল থেকে কত গান, কাব্য, সাহিত্য রচিত হয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই। শিউলি কেবল কবিদেরই বিমুগ্ধ করেনি, যুগে যুগে অসংখ্য মুগ্ধ অনুরাগী তৈরি হয়েছে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম আদর মেখে ‘শিউলি-মালা’ কাব্যগ্রন্থে লিখেছেন—
শিউলি তলায় ভোর বেলায় কুসুম কুড়ায় পল্লী-বালা।
শেফালি পুলকে ঝ’রে পড়ে মুখে খোঁপাতে চিবুকে আবেশ-উতলা।।
সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ও দরদি সুরে গেয়েছেন শিউলি ফুলকে নিয়ে—
‘শিউলি ফুলের মালা গেঁথে কারে পরাবো!
কারে আমি এ ব্যাথা জানাবো!’
উত্পত্তি
থাইল্যান্ড, বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান—এই পুরো অঞ্চলে এই ফুল দেখতে পাওয়া যায়। অঞ্চলভেদে এর ভিন্ন ভিন্ন নাম। এটি থাইল্যান্ডের রাষ্ট্রীয় ফুল। আবার ইংরেজিতে শিউলিগাছের আরেকটি নাম আছে ‘ট্রি অব সরো’। ফুলটির সংস্কৃত নাম হলো পারিজাত, হারসিংগার, শেফালিকা, নিশিপুষ্প, রাজনিহাস, প্রাজক্তা, শীতমঞ্জরি, শ্বেতসুরসা, শুক্লাঙ্গী, রঙলাসিনী, রক্তবৃন্তা, মাসিকা, নীলকা ইত্যাদি।
বেশির ভাগ ফুলের নাম সাধারণত কবিদের দেওয়া। এই শিউলিকে শেফালি নামে গেয়েছেন কবিগুরু রবীন্দ্রসংগীত—
হে ক্ষণিকের অতিথি...
এলে প্রভাতে কারে চাহিয়া।
ঝরা শেফালির পথ চাহিয়া॥
অনেকে বলেন, শিউলি এসেছে বিদেশ থেকে। অথচ খ্রিষ্টপূর্ব ৫৬ অব্দে জন্ম নেওয়া কবি কালিদাসের কাব্যে শিউলির কথা আছে। শিউলি এই উপমহাদেশেরই নিজস্ব উদ্ভিদ। আদি নিবাস মধ্য ও উত্তর ভারতে। শিউলি ফুল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য ফুল ও থাইল্যান্ডের কাঞ্চনাবুরি প্রদেশের প্রাদেশিক ফুল।
হিন্দুধর্মাবলম্বী নারীরা ঝরা শিউলি ফুল কুড়িয়ে নিয়ে যান পূজার জন্য। শিউলি এমন একটি ফুল, যা ঝরে গেলেও পূজায় ব্যবহারে কোনো বাধা নেই। এই ফুলকে দুর্গাপূজার আগমনী ফুলের মর্যাদা দিয়েছে অনেকে। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কাছেও পবিত্র পুষ্প হিসেবে বিবেচিত হয় শিউলি।
শিউলির ভেষজ গুণ
সুবাসের জন্য শিউলির যেমন কদর, তেমনি গৃহসজ্জা ও মালা গেঁথে কোনো বিশেষ জায়গা সাজানোর জন্যও এর অনেক সমাদর। আবার শিউলির ভেষজ গুণও রয়েছে। শিউলি পাতার রস স্বাদে তিতা হলেও এর পাতা, ছাল, বীজ কবিরাজি ওষুধে খুব মূল্যবান। এগুলো আমবাত, পুরোনো জ্বর, মাথার খুশকি, পিত্ত ও কফরোগে উপকারী। আবার মেদ বাড়লে, কৃমি বাড়লে, গলা বসে গেলে, দাহরোগে, মূর্ছায়, খাদ্যে বিষক্রিয়ায়, পিপাসা রোগে, সাইটিকায় শিউলি ভালো ওষুধ। অতীতে খাবারের রং হিসেবে শিউলির বোঁটার ব্যবহারও ছিল। শিউলির বোঁটাগুলো শুকিয়ে গুঁড়া করে পাউডার করে হালকা গরম জলে মেশালে চমৎকার হলদে কমলা বা জর্দা রং হয়।
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজ