সংসারের ভার কাঁধে, তবু থামেনি সুমাইয়ার স্বপ্নযাত্রা
বাবা নেই, সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি উচ্চমাধ্যমিকে পড়ুয়া সুমাইয়া আক্তার। টিউশনি করে নিজের পড়াশোনা আর সংসারের খরচ সামলান। দারিদ্র্য, একাকিত্ব, সংসারের দায়িত্ব—সবকিছুর মধ্যেও থেমে থাকেনি তাঁর স্বপ্নপূরণের যাত্রা। এবার এইচএসসি পরীক্ষায় কুমিল্লা বোর্ড থেকে জিপিএ-৫ অর্জন করেছেন সুমাইয়া।
সুমাইয়া আক্তারের বাড়ি চাঁদপুর সদর উপজেলার ৬ নম্বর মৈশাদী ইউনিয়নের দক্ষিণ হামানকর্দ্দি গ্রামে। পিতা আমির হোসেন বেপারী একটি গার্মেন্টসে ফ্লোর ইনচার্জ হিসেবে কাজ করতেন। ২০২০ সালে এক সিএনজি দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। এর পর থেকে সুমাইয়ার কাঁধে সংসারের দায়িত্ব। তখন তিনি অষ্টম শ্রেণিতে পড়তেন।
দুই বোনের মধ্যে সুমাইয়া ছোট। বড় বোনের বিয়ে হয়ে যায় আগেই। টিউশনির টাকায় খরচ চালিয়ে পল্লী মঙ্গল উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পান তিনি। কুমিল্লা বোর্ড থেকে বৃত্তিও অর্জন করেন। এবার এইচএসসি পরীক্ষায় চাঁদপুর সদর উপজেলার শাহতলী জিলানী চিশতী কলেজ থেকে অংশগ্রহণ করে জিপিএ-৫ অর্জন করেন।
দৈনিক ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা টিউশনি করেন সুমাইয়া। এর বাইরে যতটুকু সময় পান, নিজের পড়াশোনা করেন। বর্তমানে ১৫ জন শিক্ষার্থীকে পড়াচ্ছেন তিনি। সব মিলিয়ে মাসে পাঁচ-ছয় হাজার টাকা উপার্জন হয়। তা দিয়েই চলে তাঁর পড়াশোনা ও সংসারের খরচ। বাবার মৃত্যুর পর চাচার কাছ থেকেও কিছু সহযোগিতা পেয়েছে পরিবারটি।
সুমাইয়া আক্তার বলেন, ‘বাবার মৃত্যুর পর থেকে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলেছি। টিউশনি করে পড়াশোনার খরচ চালাই, সংসারও দেখতে হয়। এত কষ্টের পর এমন ফল অর্জন করা আমার জীবনের বড় অর্জন। আমার সবচেয়ে বড় স্বপ্ন—আমার মাকে সুখে রাখা।’
মেয়ের অর্জনে খুশি মা রিক্তা বেগম। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে যথেষ্ট পরিশ্রমী। সে পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করে সংসারে আমাকে সাহায্য করে। সব সময় তাঁর জন্য দোয়া করি।’
সুমাইয়ার সাফল্যে তাঁর সহপাঠী ও এলাকাবাসীরাও গর্বিত। তাঁরা জানান, ‘সুমাইয়া ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখায় মনোযোগী। এসএসসিতে জিপিএ-৫ ও বৃত্তি পাওয়ার পর থেকেই আমরা জানতাম যে সে একদিন বড় কিছু করবে।’
জিলানী চিশতী কলেজের ইংরেজি শিক্ষক জহিরুল ইসলাম খান বলেন, ‘সুমাইয়া মেধাবী। বাবা না থাকলেও সে নিজের কঠোর পরিশ্রমে আজ এই সাফল্যের পথে এসেছে। আমরা তাঁর জন্য দোয়া করি।’
কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. কামরুল হাসান বলেন, ‘সুমাইয়া টিউশনি করে নিজের পড়ার খরচ ও সংসার সামলেছে। তাঁর সাফল্যে আমরা গর্বিত। কলেজের গভর্নিং বডির দাতা সদস্য সোহেল রুশদীসহ আমাদের সব শিক্ষকই তাঁর পাশে ছিলেন।’
চাঁদপুর জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ রুহুল্লাহ বলেন, ‘চাঁদপুরে অনেক মেধাবী ও অসহায় শিক্ষার্থী রয়েছে, যারা সুমাইয়ার মতো পরিশ্রমী। আমরা এ ধরনের শিক্ষার্থীদের পাশে আছি এবং সব সময় সাহায্য করতে প্রস্তুত।’
জিলানী চিশতী কলেজের গভর্নিং বডির আজীবন দাতা সদস্য সোহেল রুশদী বলেন, ‘আমি সব সময় শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার বিষয়ে সতর্ক ছিলাম। তাঁদের ভালো ফলের জন্য আমার কলেজের শিক্ষকদের শ্রম রয়েছে। আমিও সব সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতি যথেষ্ট সজাগ দৃষ্টি রেখে আসছি। সুমাইয়া যথেষ্ট মেধাবী শিক্ষার্থী। আমরা তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করছি।’
সুমাইয়া আক্তার ভবিষ্যতে ইংরেজি বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করে একজন আদর্শ শিক্ষক হতে চান। তিনি বলেন, ‘আমি চাই দেশের একজন ভালো শিক্ষক হয়ে মানুষের সেবা করতে। কারও ওপর নির্ভর না থেকে আত্মনির্ভরশীল হতে চাই। আমার মা-ই আমার প্রেরণা।’
সুমাইয়ার এই সাফল্য প্রমাণ করে যে অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও কঠোর পরিশ্রম থাকলে কোনো প্রতিকূলতাই স্বপ্নের পথ রোধ করতে পারে না।
সদস্য, সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা