ডিসেম্বর, বিজয়ের মাস। এ মাসের পয়লা দিনটি আমাদের জন্য হয়ে উঠেছিল ব্যতিক্রমী, স্মরণীয় এবং ভাবনার গভীরতায় ভরপুর। আমরা গিয়েছিলাম গাজীপুরের সালনা অরচার্ডে। এক জীবন্ত কিংবদন্তির সাক্ষাৎ পেতে। তিনি মঈদুল হাসান— মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বিখ্যাত গ্রন্থ ‘মূলধারা ’৭১’–এর রচয়িতা এবং বাংলা একাডেমির সম্মানিত ফেলো।
বাংলা একাডেমির উদ্যোগে লেখক প্রশিক্ষণ কর্মশালার আমরা ২০ জন প্রশিক্ষণার্থী এবং কর্মকর্তারা একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে সকাল সাড়ে আটটায় যাত্রা শুরু করেছিলাম। সালনা পৌঁছাই সাড়ে ১০টায়। পৌঁছেই বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের পর্যটন রিসোর্টে হাতমুখ ধুয়ে নাশতা সারলাম। তারপর হেঁটে গেলাম সালনা অরচার্ডে—যেখানে ৯০ বছর বয়সী মঈদুল হাসান আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমাদের দেখে তাঁর উচ্ছ্বাস আর আন্তরিকতা যেন মুহূর্তেই হৃদয় ছুঁয়ে গেল। আমরাও বিস্ময় আর আপ্লুত আবেগে তাকিয়ে রইলাম, একজন কিংবদন্তিকে সামনে পেয়ে যেন স্বপ্ন দেখছি।
শুরু হলো আলোচনা পর্ব। তিনি মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিঝরা দিনগুলোকে স্মরণ করলেন অনন্য আবেগে। কীভাবে ‘মূলধারা ’৭১’ লিখলেন, কোন কোন দালিলিক তথ্য সংগ্রহ করলেন, বই প্রকাশের পর মানুষ কেমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল—সবই তিনি ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর অবস্থান ছিল কলকাতায়। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক তাজউদ্দীন আহমদের ঘনিষ্ঠ সহচর। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাজউদ্দীনের তরফ থেকে তাঁকে দিল্লি দূতাবাসে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়। তিনি তা বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর কাছে সবচেয়ে জরুরি ছিল ইতিহাস রক্ষা, তথ্য সংরক্ষণ, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সত্যকে অমলিন রাখা।
প্রায় তিন ঘণ্টার আলোচনায় আমরা জানতে পারলাম মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত শহীদের সংখ্যা, স্বাধীনতার ঘোষণার প্রেক্ষাপটসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। যার বেশির ভাগই তিনি দালিলিক প্রমাণসহ উপস্থাপন করেন।
পাশাপাশি তিনি সমাজ ও সময়ের প্রেক্ষাপটে নারী স্বাধীনতা, নারীর অগ্রযাত্রার অন্তরায়, এমনকি পোশাক–পরিচ্ছদের মতো স্পর্শকাতর বিষয়েও মানবিক ও যুক্তিনির্ভর মতামত তুলে ধরেন।
লেখালেখির ক্ষেত্রে আমরা কী ধরনের চাপে থাকি, তা জানতে চান। ভয়কে জয় করে, লোভলালসা থেকে দূরে থেকে সততার সঙ্গে লেখালেখি করার পরামর্শ দেন।
আলোচনা শেষে তিনি আমাদের ঘুরিয়ে দেখালেন তাঁর নিজ হাতে গড়ে তোলা সবুজের রাজ্য—সালনা অরচার্ড। সার–বিষমুক্ত দেশি ফল, সবজি ও অসংখ্য ফুলের সমাহার যেন প্রকৃতির এক শান্ত আশ্রয়। গোলাপ, বেলি, স্থলপদ্ম, জলপদ্ম, রজনীগন্ধা, কামিনী—সব মিলিয়ে এক মনোমুগ্ধকর ফুলেল পরিবেশ। লাউ, শিম, শসা, মিষ্টিকুমড়া, পাটশাকসহ নানা জাতের শাকসবজি রয়েছে তাঁর ভান্ডারে। ফলের সারিতে জাম্বুরা, পেয়ারা, কলা, লেবু, আম, কাঁঠাল—যেন গ্রামীণ জীবনের সহজ সৌন্দর্যের পুনরাবৃত্তি। অরচার্ডের সীমানা ঘেঁষে বিস্তৃত শাল–সেগুনের ঘন বন আমাদের দারুণভাবে মুগ্ধ করে। ঢাকার কোলাহল থেকে মুক্তি পেতে এমন সবুজ আশ্রয় সত্যিই প্রশান্তিময়।
ফেরার পথে আমরা ঘুরে দেখলাম গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরম ক্যাম্পাস। এর শান্ত পরিবেশ, সবুজ প্রান্তর আর পরিপাটি দৃশ্য যেন দিনটির সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিল কয়েক গুণ।
সালনায় কাটানো কিছু সময় শুধু একটি ভ্রমণ ছিল না, ছিল ইতিহাসের সাক্ষাৎ জ্ঞানবৃক্ষের ছায়ায় বসে সত্যের আলোকস্পর্শ করা। মঈদুল হাসানের কথা, তাঁর মানবিকতা, তাঁর সংগ্রামের স্মৃতি আমাদের মনে দীর্ঘদিন অনুপ্রেরণার আলো হয়ে জ্বলজ্বল করবে।