করোটির কথামালা (পর্ব ১৪)
মাত্র একজন পাঠকও যদি বলে, ‘লুনা, তোমার লেখা আমার জীবনের সঙ্গে মিলে যায়,’ ওই একজনই আমার জীবনের সেরা প্রাপ্তি।
জীবনে নাকি ঠিক সময়ে সঠিক আবেগ প্রকাশ করতে হয়; বেশি দেরি হলে অনুভূতি হারিয়ে যায়, মনের অনুভূতিতেও চর পড়ে, ভাটা পড়ে। তখন আর টগবগে অনুভূতি প্রকাশ পায় না। এমন সব ভাবনা থেকেই লিখতে বসে যাই। ভাবি, না লিখলে নিজের সময়কেই বা ধরে রাখব কী করে? অনেক বছর আগে কে যেন বলেছিল, ‘আপনি কী এমন লেখেন যে বই বের করতে চান, কে পড়বে আপনার বই?’
খুব সাহসের সঙ্গে উত্তরে বলেছিলাম, ‘কেউ পড়বে না আমার বই। নিজেই পড়ব আমার লেখা। আপনার অসুবিধা আছে?’
ভয়ংকর এক ভোগবাদী সময়ে বাস আমাদের। আমি যদি পাল্টা প্রশ্ন করি, ‘১০ লাখ টাকার গয়না জমিয়ে ব্যাংকে রাখেন কেন আপনি? কী এমন জীবন আপনার? কে আছে আপনার দিকে তাকিয়ে গোটা জীবন পার করবে?’ আসলে জীবন হচ্ছে এমন অসাধারণ এক প্রাপ্তি, যার কোনো ছকবাঁধা উত্তর চলে না। বরং একটা উদাহারণ খুব মনে ধরে— কেউ দুধ বেচে মদ খায়, কেউ মদ বেচে দুধ খায়; এটা ব্যক্তির চাহিদার ওপর নির্ভরশীল।
১১ বছর পর দেশে যাওয়ার আগে নানা আয়োজন করেছিলাম, উত্তেজনাও ছিল ভীষণ। একটা বড় আনন্দ মাথায় নিয়ে গিয়েছিলাম, আমার বইয়ের একটা প্রকাশনা অনুষ্ঠান করব। প্রকাশনা সংস্থা সাদাকালো এযাবৎ আমার ছয়টা বই বের করেছে। তারাই আয়োজন করবে সব, কিন্তু অতিথিদের তো আমাকেই বলতে হবে। কথা ছিল, শেষের দুটো বই ‘আয়নায় নিজের মুখ’ ও ‘ভাবনার মুহূর্তগুলো’ নিয়ে একটা অনুষ্ঠান হবে। অনেকটা ঘরোয়া, আবার কিছুটা বরেণ্য ব্যক্তিদের নিয়ে। এমন ভাবনা নিয়ে ঢাকায় রওনা দিই। কিন্তু ঢাকায় গিয়ে নিজের মনের একান্ত ভাবনাটা ভীষণ পাল্টে যায়— অসহনীয় যানজট পেরিয়ে মানুষ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায় কী করে?
সময় এগোতে থাকে। ফেব্রুয়ারির ৯ তারিখে শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠানের দিনটাও এগোতে থাকে। আগের লেখায় বলেছি, শত ইচ্ছায়ও আমি ঢাকায় ফেসবুক খুলিনি। একটা জেদ ছিল, ফেসবুক ছাড়া কি জীবন অচল হবে নাকি? শেষের কথাটা প্রথমে বলে রাখি, এবার ঢাকায় আমি সবচেয়ে বেশি মানুষের দেখা পেয়েছি। আসলে ইচ্ছাটা মনের, সাহসটা নিজের, ফেসবুক উছিলামাত্র।
ফেব্রুয়ারির ৩ বা ৪ তারিখে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের হাসান আরিফের একটা আবৃত্তি শুনতে যাই জাতীয় জাদুঘরে। সেখানে দেখা পাই জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যারের। ২২ বছর আগে সখ্য ছিল স্যার ও চাচির সঙ্গে। অনেক অনেকবার দেখা হতো স্যারের সঙ্গে, নানা আয়োজনে কথা হতো। কিন্তু এত দিন পর স্যার কেন মনে রাখবেন আমাকে? জাদুঘরের অনুষ্ঠান শেষে স্যার বেরিয়ে আসছিলেন, আমি গিয়ে স্যারের সামনে দাঁড়াই। স্যার হাতে ধরে বলেন, ‘কী লুনা, আমার সব যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেছ? ছেলে কত বড় হলো?’ আমি অভিভূত হয়ে যাই, এ–ই না হলে শিক্ষক! আমার বইয়ের অনুষ্ঠানে স্যার যে প্রধান অতিথি হয়ে আসবেন, এটা তিনি ফোনেই নিশ্চিত করে দেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক আমিরুল ইসলাম চৌধুরী, আমার বাল্যবন্ধু বিন্দুর বাবা। আমার বাবারও বন্ধু আমিরুল ইসলাম চাচা। বিন্দুর মা বেনু চাচি আমার জীবনে দেখা সেরা একজন মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের পাঁচ বছর চাচার বাসা ছিল আমার নিজের বাসা। কিন্তু এসব দিয়ে কি আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে আমিরুল ইসলাম চাচা সেই এলিফ্যান্ট রোড থেকে শিল্পকলায় আসবেন? চাচা এসেছিলেন পরম ভালোবাসা থেকে।
ব্র্যাকের চাকরিজীবনে আফসান চৌধুরী ছিলেন আমার বস, ডিরেক্টর। অনুষ্ঠানে ছিলেন তিনি, আমার লেখার ভালো–মন্দ নিয়ে কথা বলেছেন। আমার লেখা বই ‘ছায়া বিথীতলে’–তে আছে আফসান ভাইয়ের লেখা ভূমিকা। তিনি যখন অনুষ্ঠানে কথা বলছিলেন, আমার বারবার মনে হতে থাকে, জীবনের কোনো সৎ যোগাযোগ বৃথা যায় না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর নুরুল আলম স্যার এসেছিলেন, সঙ্গে আমার লেখার একান্ত পাঠক মিসেস আলম। স্যার কথা বলেছেন আমার ২৭ বছর আগের ছাত্রীজীবন নিয়ে। স্যার হেসে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে তোমাকে ছেড়ে দিলাম মেয়ে হিসেবে, এখন দেখছি তুমি মহিলা হয়ে গেছ।’ স্যার বুঝতে পারেন না, মাঝখানে মাত্র ২৭ বছর চলে গেছে। আমাকে নিয়ে কথা বলেছেন এই প্রিয় শিক্ষক এত বছর পরে।
জীবনে কোথাও কোনো প্রাপ্তিযোগ রাখব না। এই জীবন মাত্র একবারই পাই আমরা। ভালোবাসার পদ্মপাতার এই জীবনে সবচেয়ে বড় পাওয়া হলো, কিছুই না পাওয়ার জন্য মনকে প্রস্তুত রাখা।
এসেছিলেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা। ব্র্যাকে আমার প্রোগ্রাম হেড ছিলেন। ২০০২ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত কত কত ঘণ্টা যে একান্তে আপার সঙ্গে পার করেছি, নিজেদের মনের কথা ভাগাভাগি করেছি, ঢাকা থেকে দূরের শহরে আপার সঙ্গে ভ্রমণ করেছি আর কথা বলেছি নিজেদের জীবনের বাস্তবতা নিয়ে। অনুষ্ঠানের দিন অন্য একটা আয়োজন থেকে আপা দৌড়ে এসেছিলেন আমার বইয়ের আয়োজনে। দূরে আপাকে বসে থাকতে দেখে মনে হয়েছে, প্রিয় মানুষেরা কি এমনই হয় আজন্ম?
অনেকের নাম বাদ পড়ছে। বিশেষ করে আমার বন্ধুরা, সহকর্মীরা যাঁরা গত ১৪ বছরে প্রবাসজীবনের কাহিনি পড়েছেন ফেসবুকে। যাঁরা এসেছিলেন, অসহ্য যানজট পার হওয়ার সময় তাঁরা আমার কথা মনে রেখে সহিষ্ণু হয়েছেন। এই বিরল সম্মান পাওয়ার কী যোগ্যতা আছে আমার? এই নীরব সকালে যখন লিখছি, তখন সবাইকে জানাতে ইচ্ছা করছে, দেশে না গেলে কী করে জানব, কতটুকু ভালোবাসা জমা আছে?
সবার চেহারা ভেসে উঠছে মনের পর্দায়; বন্ধু আশরাফ কায়সার কথা বলেছে আমাকে নিয়ে, আমাদের বন্ধুত্বের জীবন নিয়ে। ইচ্ছা করছে, কায়সারকে জিজ্ঞাসা করি, ‘এমন দিনও দেখার বাকি ছিল যেদিন আমাকে নিয়ে কথা বলার জন্য তোর সামনে মাইক থাকবে? জীবন এক বিস্ময়কর ঘোরটোপ, তা–ই না কায়সার?’
এসেছিলেন আমার মামা, খালা, অনেক কাছের দূরের আত্মীয়-পরিজনেরা, আমার মা–বাবা ও বোনেরা ছিলেন অনুষ্ঠানজুড়ে। একান্ত কাছের স্বজন হাসান আরিফ ছিলেন অনুষ্ঠানের মূল চালিকা শক্তি।
আজ আর নয়। অনেক অনেক আবেগ দমন করে লেখা শেষ করি প্রতিবার। আবারও সেই প্রথম বাক্যের কথা শেষে, আমি কথামালা লিখি নিজের ভালোবাসা থেকে, নিজের সঙ্গে নিজেই কথা বলার এই আয়োজন আমার।
মাত্র একজন পাঠকও যদি বলে, ‘লুনা, তোমার লেখা আমার জীবনের সঙ্গে মিলে যায়,’ ওই একজনই আমার জীবনের সেরা প্রাপ্তি। জীবনে কোথাও কোনো প্রাপ্তিযোগ রাখব না। এই জীবন মাত্র একবারই পাই আমরা। ভালোবাসার পদ্মপাতার এই জীবনে সবচেয়ে বড় পাওয়া হলো, কিছুই না পাওয়ার জন্য মনকে প্রস্তুত রাখা।
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
টরন্টো, কানাডা