করোটির কথামালা (পর্ব ১৩)

ছবি: এআই/বন্ধুসভা

নিজেকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গতকাল ভোর ৩টায় উঠেছিলাম।

পড়ার টেবিলের পাশে যে বড় কাচের জানালা, তার ওপারে টরন্টো শহরের ফেব্রুয়ারি মাসের পুরু বরফে ঢেকে থাকা শহর। যত দূর চোখ যায়, বরফ আর বরফ। মেইন রাস্তা এবং পায়ে চলা পথগুলোতে বরফ পরিষ্কার করেছে সিটির কর্মীরা। তবু ভীষণ সাবধানে পা ফেলতে হবে। চকচকে কাচের মতো জমাট বাঁধা বরফে হেঁটে হেঁটে অফিসে রওনা করেছি ভোর সাড়ে পাঁচটায়। মাথা তুলে পৃথিবীর দিকে তাকাতে সাহস হয়নি। কারণ, প্রতিটা পা ফেলার আগে দেখে নিতে হচ্ছে কোথায় পা ফেলছি। মুহূর্তের অসতর্কতা বাকি জীবন ভোগাবে। এ দেশে বরফে পড়ে গিয়ে হাত-পা ভেঙে খোঁড়া হয়ে আছে, এমন ঘটনা নেহাত কম নয়।

চার সপ্তাহ পরে অফিসে যাব। নিজের কাজগুলো বুঝে নিতে হবে। কতগুলো নতুন পরিবারকে অ্যাসাইন করা হয়েছে, কী কী জরুরি মেইল এসেছে, অফিসে নতুন কোনো পরিবর্তন এল কি না—এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে অন্ধকার ভোরেই অফিস পৌঁছালাম। ২৪ ঘণ্টার জন্য ওপেন শেল্টার সার্ভিসে আমরা যেকোনো স্টাফ যেকোনো সময় গিয়ে অফিস শুরু করতে পারি, কাজ শুরু করতে পারি; মাস শেষে নিজের কাজ বুঝিয়ে দিতে হবে। কেউ মনিটর করবে না, কেউ মাথার ওপরে চড়াও হবে না।

গতকাল ভোর থেকে এই মুহূর্ত অবধি সব কাজের ভেতরেও বারবার মনে হচ্ছে—ঘুমের মধ্যে লুইসের নিঃশব্দ মৃত্যু হলো, কে অফিসে খবর দিল?

অফিসের ই-মেইলে ১৫৫টা মেইল জমেছিল। এর ভেতর একটা মেইল চোখে পড়ল—লুইস এ্যশ্তে মারা গেছে। গতকাল সারা দিন দম ফেলার মতো সময় পাইনি। আমার টেবিলে মোট ৯টা পরিবারের ফাইল, কেউ কেউ পরিচিত হতে এসেছে। আরও আছে ফেলে যাওয়া কাজের অংশ, অফিসের প্রতিদিনের কাজ তো আছেই। কিন্তু লুইসের কথাটা একমুহূর্তের জন্য মাথা থেকে সরাতে পারিনি।

মানুষ জন্মালে মারা যাবে। ৬৮ বছর বয়সী লুইস কষ্টির অ্যাডমিন স্টাফ ছিল। ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করেছে আমাদের সঙ্গে। মার্কিন নাগরিক লুইস কেন আমেরিকা ছেড়ে কানাডায় স্থায়ী হয়েছিল, সেই ইতিহাস জানি না। তবে তার দুই ছেলে যে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকে, সেটা বলেছিল লুইস। ২০১২ সালে কষ্টির নিজস্ব শেল্টার অফিস ডাউনটাউন টরন্টোতে মাত্র ৯ মাস কাজ করেছিলাম, সেই সময় লুইসের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়।

ভীষণ একাকী মানুষ লুইস সিগারেট খেত খুব। একদিন বললাম, ‘এত সিগারেট খাও কেন? কোনো কঠিন অসুখ হলে কে দেখবে তোমাকে?’ ভীষণ ফরসা আর অপরূপ সুন্দর দেখতে লুইস। বয়সের তারতম্যেও মানুষকে ভীষণ মিষ্টি লাগে—লুইসকে তেমন মনে হতো। সেদিন হেসে দিয়ে বলল, ‘তুমি কি মনে করো তোমার অসুখ না হলেও তোমাকে কেউ দেখবে? জানো মাহমুদা, জীবনে কেউ কাউকে দেখে না—এটা বুঝতে আমাদের গোটা জীবন লেগে যায়।’ এই বলে জমাট বাঁধা বরফে লুইস আবার সিগারেটে টান দিয়ে নিজের নিশ্বাসকে উত্তাপ দেয়।

সেদিনের স্মৃতিটা এখনো মাথা থেকে সরাতে পারছি না। লুইস চলে গেছে, লুইস চলে গেছে—এই লাইনটা কেন গুবড়ে পোকার মতো মাথা দখল করে আছে, সেটাও বুঝতে পারছি না।

গতকাল ভোর থেকে এই মুহূর্ত অবধি সব কাজের ভেতরেও বারবার মনে হচ্ছে—ঘুমের মধ্যে লুইসের নিঃশব্দ মৃত্যু হলো, কে অফিসে খবর দিল? ওর দুই ছেলে আমেরিকায় বসে খবর পেল কী করে? মরে যাওয়ার আগে যে সিগারেটে টান দিয়েছিল লুইস, সেটা কি সে বুঝতে পেরেছিল আর দম থাকবে না ওর?

আরও পড়ুন

অন্য একটা স্মৃতি লিখে লেখাটা শেষ করি। ফেব্রুয়ারি মাসের ১০ তারিখে ধানমন্ডি সাতমসজিদ রোডের ৭৬৫ নম্বর বাড়িতে গিয়েছিলাম। একাই গিয়েছিলাম। বাড়িটা দেখতে, নিজের ফেলে আসা সময়কে আরও একবার দেখতে। ১৯৯৫ সালের কোনো এক মাসে ওই বাসায় প্রথম গিয়েছিলাম। এরপরে কত সহস্রবার ওই বাসায় গিয়েছি, সময় পার করেছি; সেই কথা এখন আর হিসাব করে বলতে পারব না। ওই বাসার মালিক প্রফেসর খান সারোয়ার মুর্শিদ ও নুরজাহান মুর্শিদ। যাঁদেরকে পরিচয়ের মুহূর্ত থেকে নানা-নানি ডাকতাম। মুর্শিদ নানা চলে গেছেন ২০১২ সালে, আমি তখন টরন্টোতে। এই বরফের মাসেই নানার মৃত্যুসংবাদ পেয়েছিলাম অন্য একটা বাসায় বসে। ঢাকায় তখন ভোর, খবরটা টেলিভিশনে শুনলাম। যদিও বেশ কিছুদিন ধরে খবর পাচ্ছিলাম নানা হাসপাতালে কষ্ট পাচ্ছেন।

৯ বছর পরে, মানে ২০১২ থেকে ২০১৯ সাল। ঢাকা থেকে চলে আসার দুই দিন আগে ভীষণ ইচ্ছা হলো নানাবাড়িটা দেখে আসব। বাসাটা একই রকম আছে। দেয়াল থেকে চুন, পলেস্তারা খসে খসে পড়ছে; তবু চেষ্টা করা হয়েছে বাড়ির মূল আদল ধরে রাখার। প্রতিটা ঘর, প্রতিটা জায়গা স্পর্শ করে করে দেখি। একজন অফিস স্টাফ ছিলেন, নাম রফিক। আমি টিস্যু বক্স হাতে ক্রমাগত কাঁদছি আর জানালা, দরজা, দেয়াল, টেবিল, ঘরের কোনা স্পর্শ করছি—রফিক খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। সেই মাত্রা কতটা ছিল, সেটা বুঝতে পারলাম যখন সন্ধ্যায় শারমিন আপা (শারমিন মুর্শিদ, নানার ছোট মেয়ে) আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন।

সেদিন নানার বাসা থেকে ফেরার পথে ঢাকা শহরটা ভীষণ খালি মনে হচ্ছিল। মানুষ চলে গেলে স্মৃতি ফেলে যায়, কিন্তু সত্যিকার ভালোবাসার স্মৃতি ভারী পাথরের মতো মনের ভেতর জায়গা দখল করে থাকে।

নানা-নানি আমাকে ভালোবাসতেন, স্বার্থ ছাড়া ভালোবাসা। কেন আমাকে কাছে টানবেন এত বড় দুজন মানুষ? মনে আছে, যখন নানার সঙ্গে কোথাও যেতাম বা কোনো বড় অনুষ্ঠানে নানা প্রধান অতিথি হতেন—নানা হেসে বলতেন, ‘বুঝেছিস লুনা, এই শহরে আমি এখন সবচেয়ে সিনিয়র। আমি সবাইকে তুমি বলব, কিন্তু সবাই আমাকে আপনি বলবে।’ কী ভীষণ সুপুরুষ ছিলেন নানা। ভীষণ সুন্দর করে কথা বলতেন, ইংরেজি বলতেন খাঁটি ব্রিটিশ উচ্চারণে, একদম সাহেবি কায়দায়।

বাংলাদেশের প্রথম নারী মন্ত্রী নুরজাহান মুর্শিদ ১৯৯৭ সালে অসুস্থ্ হয়ে যখন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, তখন শারমিন মুর্শিদের সংস্থা ব্রতিতে কাজ করতাম। নানির দেখাশোনা করব বলে মুরশিদ নানার সঙ্গে আলাপ করে ব্রতির চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম। নানাকে এত কাছে থেকে দেখেছি যে আজ এত বছর পরে সেসব ভাবলে কেমন ঘোরলাগা অনুভূতি কাজ করে।

সময় চলে যাচ্ছে। ৫টা বাজতে চলল, অফিস যেতে হবে, টেবিল ছাড়তে হবে। লুইস, নানা, নানি, সরদার স্যার—সবাই চলে গেছে।

সেদিন নানার বাসা থেকে ফেরার পথে ঢাকা শহরটা ভীষণ খালি মনে হচ্ছিল। মানুষ চলে গেলে স্মৃতি ফেলে যায়, কিন্তু সত্যিকার ভালোবাসার স্মৃতি ভারী পাথরের মতো মনের ভেতর জায়গা দখল করে থাকে। সেটা এড়ানো যায় না, ভোলাও যায় না। পথ চলতে গেলে সেই স্মৃতি সামনে এসে দাঁড়ায়, পথ রোধ করে না; কিন্তু মনে করিয়ে দেয়, জীবনে নিঃস্বার্থ হতে শিখতে হবে, ভালোবাসায় কোনো স্বার্থ রাখতে হয় না। লুইস, মুর্শিদ নানা, নুরজাহান নানি, সরদার স্যার আমাকে জীবনের কাছে ঋণী করে দিয়ে গেছেন।

২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

টরন্টো, কানাডা