শোলার শৈল্পিক সৌন্দর্য কি হারিয়ে যাচ্ছে
আজ সেই দৃশ্যগুলো প্রায় বিলীন। বাজার এখন দখল করেছে রঙিন প্লাস্টিক, ঝলমলে থার্মোকল আর চায়নিজ সাজসামগ্রী।
সময় বয়ে চলে, বদলায় মানুষের জীবনধারা। নতুনের আগমনে হারিয়ে যায় অনেক পুরোনো শিল্প-সংস্কৃতি। গ্রামবাংলার উৎসব মানেই আচার-অনুষ্ঠান আর রঙিন জীবনযাপন। সেই জীবনচিত্রে শোলার কাজ ছিল এক অদৃশ্য সৌন্দর্যের রেখা। বিয়ের মঞ্চে বর-কনের মাথায় সাদা মুকুট, পূজা-পার্বণে দেবীর অলংকার আর ঘরের দেয়ালে ঝোলানো নকশা কিংবা মেলায় শিশুদের হাতে শোলার খেলনা—সবকিছুতেই ছিল এক অপার্থিব স্বাদ। শোলার শৈল্পিকতায় মিশে থাকত গ্রামীণ জীবনের সরলতা, শিল্পীর নিপুণ হাতের উষ্ণতা আর এক গ্রামীণ আভিজাত্য।
সময়ের পাল্লায় টিকতে না পেরে অনেক ঐতিহ্য হারিয়ে যায়। শোলাশিল্পও সেই পথে। আধুনিকতার পাল্লায় পড়ে শোলাশিল্পের দীপ্তি ধীরে ধীরে নিভে এসেছে। একসময় গ্রামীণ শিল্পীরা পানিতে ভাসমান শোলার গাছ কেটে আনতেন, তারপর দীর্ঘ ধৈর্য আর নিষ্ঠা দিয়ে গড়ে তুলতেন মাথার মুকুট, খেলনা আর নানা অলংকার। শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় সাধারণ এক সাদা কাণ্ড রূপ নিত অনন্য শিল্পকর্মে। রাতভর পরিশ্রমের বিনিময়ে শিল্পী পেতেন শৈল্পিক আনন্দ আর জীবিকার স্বাদ।
আজ সেই দৃশ্যগুলো প্রায় বিলীন। বাজার এখন দখল করেছে রঙিন প্লাস্টিক, ঝলমলে থার্মোকল আর চায়নিজ সাজসামগ্রী। এগুলো দেখতে আকর্ষণীয়, দামেও কম আর টেকসইও বটে। ফলে শোলার জিনিসপত্রের কদর হারিয়ে। যেসব শিল্পীরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম শোলার কাজ শিখেছেন, তাঁদের অনেকেই আজ পেশা বদলেছেন। কেউ কৃষিকাজের দিকে ঝুঁকছেন আবার কেউ রিকশা চালাচ্ছেন। কেউ–বা শহুরে দিনমজুর হয়েছেন কিংবা কাঁধে তুলে নিয়েছেন যান্ত্রিক ঝুলি।
এই শিল্পের প্রতি আগ্রহ হারিয়েছে তরুণ প্রজন্ম। তাঁদের কাছে শোলা কেবল অচেনা এক নাম, বইয়ের পাতার ইতিহাস। অথচ এ শিল্প ছিল গ্রামীণ সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। শোলার মুকুটে ছিল বিয়ের আনন্দ, প্রতিমার সাজে ছিল ধর্মীয় ভক্তি আর খেলনায় ছিল শৈশবের হাসি। এখন বিয়ের আনন্দ কিংবা প্রতিমার সাজে সবকিছুই ম্লান হয়ে যাচ্ছে আধুনিকতার আলোয়।
তবু আশার আলো একেবারে নিভে যায়নি। এখনো কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা শোলার কারুকাজ আঁকড়ে ধরে আছেন প্রাণপণে। তাঁরা মনে করেন, যদি সঠিক উদ্যোগ নেওয়া যায়, এই শিল্প আবারও নবজীবন ফিরে পাবে। অনলাইন বাজারে শোলার পণ্য বিক্রি হলে সারা দেশের মানুষ এই ঐতিহ্যকে নতুন করে চিনবে। কারুশিল্প মেলা, প্রদর্শনী কিংবা আন্তর্জাতিক হস্তশিল্প মঞ্চে তুলে ধরা গেলে শোলার অলংকার আবার কদর পাবে।
শোলাশিল্প কেবল একটি কারিগরি কাজ নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতির গর্ব। এর মধ্যে লুকিয়ে আছে বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য আর শিল্পীর শৈল্পিক আবেগ, গ্রামের নস্টালজিক ভাবনা। শিল্প বাঁচাতে যদি আমরা হাত বাড়াই, তাহলে আগামী প্রজন্মকে বলতে পারব—‘দেখো, এটাই সেই শোলাশিল্প, যা একসময় আমাদের জীবন সাজিয়েছে।’ আর যদি চুপ করে থাকি, হয়তো একদিন শিশুরা বইয়ের পাতায় পড়বে—বাংলায় একসময় শোলাশিল্প ছিল, কিন্তু মানুষ তাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি।
শোলার শুভ্র নকশার মতো সরল, শান্ত ও মনোহর এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা সবার দায়িত্ব। ঐতিহ্য হারালে কেবল একটি শিল্প হারায় না, হারিয়ে যায় এক টুকরা ইতিহাস, এক টুকরা স্মৃতি, এক টুকরা বাংলাদেশ।
বন্ধু, গাজীপুর বন্ধুসভা