মেঘনাতীরের ক্যাফে, ইতিহাস ও বন্ধুত্বের গল্প

মাটি ক্যাফের পাশেই পুকুরপাড়জুড়ে কাশফুলের সারি।

নভেম্বরের এক শীতমাখা সকালে গুলিস্তান থেকে চেপে বসলাম মেঘালয় পরিবহন বাসে। গন্তব্য মাধবদী, নরসিংদী। তিন দিন আগেই মাধবদীতে উৎপত্তি হয়েছিল ৫ দশমিক ৭ মাত্রার এক ভূমিকম্প। সেই ভূমিকম্পের জন্য দেওয়া ছুটিতে মাধবদী বেড়াতে যাচ্ছি ভেবে একটু অদ্ভুত লাগছিল।

ঢাকা থেকে মাধবদীর যাত্রাপথের আশপাশে প্রায় সবই কলকারখানা—বিশেষ করে কাপড়ের কারখানা। দু-এক জায়গায় রোদে শুকাতে দেওয়া রঙিন সুতোও চোখে পড়ল। পাশে বসা অপরিচিতা সহযাত্রী প্রথমবার যাচ্ছি শুনে পথ চিনিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি দাওয়াত দিলেন তাঁর বাসায়। সব মিলিয়ে বেশ ফুরফুরে মন নিয়ে গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে যাত্রাপথ বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠল।

বাস থেকে নামতেই দৃশ্যমান হলো বান্ধবীর হাসিমুখ। এক থোকা নাকচাঁপা, একটি লাল জারবেরা ও উষ্ণ আলিঙ্গন দিয়ে অভ্যর্থনা জানাল। মাধবদী নেমেই চোখে পড়ল শীর্ণকায়া পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদ। এককালের প্রতাপশালী নদ আজ বুকে ধরে রেখেছে আবর্জনার ভার।

ক্যাফেসংলগ্ন ছোট পুকুরে বাঁধা রঙিন নৌকা।

আতিথেয়তা ও আহারপর্ব শেষে বেরিয়ে পড়লাম দুজন পলাশ উপজেলার পথে, গন্তব্যস্থল লক্ষ্মণসাহার জমিদারবাড়ি। চলতি পথে হঠাৎ বান্ধবী খেয়াল করল গিরিশচন্দ্র সেনের বাড়ি পেরিয়ে চলে যাচ্ছি। গিরিশচন্দ্র সেন ছিলেন পবিত্র আল কোরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক ও প্রকাশক। অটো থামিয়ে নেমে পড়লাম জলদি। একটু হাঁটতেই চোখে পড়ল ইটের দোতলা বাড়িটি। বাড়ির গাঢ় সবুজ রঙের দরজায় ঝুলছিল তালা, কেয়ারটেকারকে খোঁজাখুঁজি করেও পাওয়া গেল না। জানা গেল অলিখিত ছুটি কাটান তিনি প্রায়ই। উঁকিঝুঁকি মেরে দেখলাম ভেতরে কিছু বইপত্র ও ব্যবহার্য সামগ্রী রয়েছে। অগত্যা কয়েকটি ছবি তুলে বেরিয়ে এলাম। মন খারাপ হলো ঐতিহাসিক এই বাড়ির এত দুর্বল রক্ষণাবেক্ষণ দেখে; কোনো স্মারক নেই, আশপাশে রিকশার গ্যারেজ—অথচ সঠিক যত্নে এটি হতে পারত সময়কে, ইতিহাসকে জানার এক স্থাপনা।

স্থাপত্যশৈলী ও কারুকার্যের বিবেচনায় বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর জমিদারবাড়ি হলো লক্ষ্মণসাহার বাড়ি। প্রতিটি খিলান, থাম, দরজায় অপূর্ব সুন্দর সুরকির কাজ করা, যা উৎকৃষ্ট রুচির পরিচায়ক। জমিদারবাড়ির পাশেই আছে বাঁধানো পুকুরঘাট, আর তিনটি মঠ। দ্বিতল জমিদারবাড়ির অলিন্দে ঘুরে বেড়ালাম বেশ কিছুক্ষণ, বিশ্রাম নিলাম শানবাঁধানো পুকুরঘাটে। চারপাশে সবুজ গাছপালা আর সামনে আদিগন্ত হলুদ ধানের খেত জমিদারবাড়ির প্রাঙ্গণকে করেছে আরও শোভনীয়। তবে সেই পুরোনো দুঃখ; আরও নিবিড় রক্ষণাবেক্ষণ বিশেষ প্রয়োজন ছিল।

মাটি ক্যাফে থেকে মেঘনার সৌন্দর্য।

জমিদারবাড়ি থেকে যখন প্রস্থান করলাম তখন অপরাহ্ণ প্রায়। আরামদায়ক রোদ মেখে চললাম নাগরিয়াকান্দির পথে। কিন্তু সুন্দর এই যাত্রাপথে মনঃকষ্ট পেলাম এক পথিকের অযাচিত আচরণে। যার পোশাক তার স্বাধীনতা কিংবা স্থান–কাল–পাত্র বিবেচনায় না এনে মন্তব্য প্রদান যে ব্যক্তিত্ববানের কর্ম নয়; সেই বোধ কি কিছু মানুষের আদৌ হবে?

মন খারাপকে ঝেড়ে ফেলতে বান্ধবী নিয়ে চলল তার প্রিয় ক্যাফেতে। মেঘনার কোলে লুকিয়ে থাকা অনাড়ম্বর ‘মাটি ক্যাফে’। শীতে পানি সরে গিয়ে যদিও এখন চর জেগেছে। বাঁশ, কাঠ, ছনের তৈরি ছোট একটি ক্যাফে; ভেতরে তাকজুড়ে রাখা বই, রেডিও, ক্যাসেট, হারিকেনসহ আরও নানা বাহারি উপকরণ। ক্যাফেসংলগ্ন ছোট পুকুরে বাঁধা একটি রঙিন নৌকা, পুকুরপাড়জুড়ে কাশফুলের সারি— সব মিলিয়ে চোখের প্রশান্তি।

সন্ধ্যাটা ক্যাফেতেই কাটালাম গান শুনে আর আড্ডা দিয়ে।

ক্যাফেতে ঢুকেই মন ভালো হয়ে গেল। দুই কাপ চা খেয়ে নৌকায় উঠলাম। সূর্য তখন পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ছে, আর কিছু সময় পরেই মিলিয়ে যাবে মেঘনার গহিনে। উত্তুরে হাওয়া গায়ে মেখে গোধূলিবেলায় প্রিয় সখীর সঙ্গে নৌভ্রমণ— এমন মনোরম অনুভূতি জীবনে কবার আসে!

ক্যাফের পাশেই ছোট পাহাড়ি টিলার মতো স্থানে দোলনায় চড়ার অনুভূতিও অসাধারণ। অপরিচিত এক পরিবারের সদস্যদের উচ্ছল নৌভ্রমণ দেখে খুব আনন্দ পেলাম। পরিবারের মহিলা সদস্যরাও বইঠা বাইছিলেন, মেতে ছিলেন হাসিঠাট্টায়, খাওয়াদাওয়ায়; এমন পরিবারই তো আমরা চাই!

ক্যাফের স্বত্বাধিকারী ভাই এবং তাৎক্ষণিক পরিচিত নরসিংদীর আরও কিছু মানুষের দারুণ আপ্যায়ন মন ভরিয়ে দিল। সন্ধ্যাটা ক্যাফেতেই কাটালাম গান শুনে আর আড্ডা দিয়ে। ব্যাকগ্রাউন্ডে ছিল ঝিঁঝি পোকার কনসার্ট আর মাঝেমধ্যে শিয়ালের ডাকে ছন্দপতন। এভাবেই সমাপ্তি হলো সুন্দর একটি দিনের; তবে রেশ এতটাই আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে কবির ভাষায় বলতে হয়—শেষ হইয়াও হইল না শেষ।

শিক্ষার্থী, রসায়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়