একজন ডাক্তার, যিনি বিশ্ব বদলাতে চেয়েছিলেন
ছোট্ট এর্নেস্তো গুয়েভারার ডাকনাম ছিল ‘চে’। আর্জেন্টিনায় ‘চে’ মানে ‘এই যে’! এই সাধারণ ডাকনামের ছেলেটিই একদিন হয়ে ওঠেন বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত মুখগুলোর একটি। তাঁর মুখের ছবি আজও দেখা যায় টি-শার্টে, দেয়ালে, বইয়ের মলাটে। তিনি ছিলেন এমন একজন মানুষ, যিনি নিজের জীবনের লক্ষ্য বানিয়েছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো আর মানুষের জন্য লড়াই করা।
১৯২৮ সালের ১৪ জুন, আর্জেন্টিনার রোজারিও শহরে জন্ম চে গুয়েভারার। মা–বাবা দুজনই শিক্ষিত ছিলেন। কিন্তু ছোট থেকেই চে হাঁপানিতে ভুগতেন। ডাক্তাররা বলেছিলেন, ঠান্ডা জায়গায় থাকতে হবে। তাই তাঁর পরিবার এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে বেড়াত। শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও চে কখনো হার মানেননি। তিনি রাগবি খেলতেন, সাঁতার কাটতেন, প্রচুর বই পড়তেন। নিজের রোগের সঙ্গে লড়াই করেই তিনি বুঝেছিলেন মানুষের দুঃখ বোঝার নামই জীবন।
১৯৫১ সাল, চে তখন মেডিকেল কলেজের ছাত্র। বন্ধু আলবার্তো গ্রানাদোর সঙ্গে একটা পুরোনো মোটরসাইকেলে চড়ে বেরিয়ে পড়লেন লাতিন আমেরিকা ঘুরে দেখতে। এই সফরই তাঁর জীবন বদলে দেয়। তিনি পেরুতে দেখলেন দরিদ্র কৃষকদের কষ্ট, চিলিতে দেখলেন খনিশ্রমিকদের দুর্দশা, আর ভেনেজুয়েলায় দেখলেন কীভাবে আমেরিকান কোম্পানিগুলো তেল লুটে নিচ্ছে আর মানুষকে বঞ্চিত করছে। এই ভ্রমণ শেষে চে লিখেছিলেন, ‘আমি আর শুধু ডাক্তার হতে চাই না, আমি চাই এই অন্যায় বদলাতে।’
১৯৫৫ সালে, মেক্সিকোতে তাঁর দেখা হয় তরুণ বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে। কাস্ত্রো বললেন, ‘কিউবায় একজন খারাপ শাসক আছে বাতিস্তা। আমরা তাঁকে সরাতে চাই।’ চে দ্বিধা না করে রাজি হলেন। তাঁরা ৮২ জন যোদ্ধা নিয়ে ছোট নৌকা গ্রানমায় চড়ে কিউবার পথে রওনা দেন। জঙ্গলে লুকিয়ে শুরু হয় গেরিলা যুদ্ধ। চে ছিলেন একই সঙ্গে ডাক্তার, শিক্ষক ও যোদ্ধা। তিনি আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা করতেন, গ্রামের শিশুদের পড়াতেন, আর যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতেন। সান্তা ক্লারার যুদ্ধে তাঁর নেতৃত্বেই বিপ্লবীরা জয়লাভ করে। শেষ পর্যন্ত ১৯৫৯ সালের ১ জানুয়ারি, বাতিস্তা পালিয়ে যায় এবং কিউবায় বিপ্লব জয়ী হয়।
বিপ্লবের পর চে হয়ে ওঠেন কিউবার জাতীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ও শিল্পমন্ত্রী। তিনি চেয়েছিলেন যেন সবাই বিনা খরচে শিক্ষা ও চিকিৎসা পায়, কৃষকেরা জমির মালিক হয়, আর কেউ ক্ষুধায় না থাকে। তিনি টাকা সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘এটা শুধু কাগজ মাত্র।’ সই করার সময়ও লিখতেন কেবল ‘চে’, যেন সবাই মনে রাখে। তিনি ছিলেন এক সাধারণ মানুষ, ক্ষমতার নয়, ন্যায়ের পক্ষে। কিন্তু চে এখানেই থামেননি। তিনি চেয়েছিলেন পুরো পৃথিবী বদলাতে। তাই তিনি গিয়েছিলেন আফ্রিকার কঙ্গোতে, পরে বলিভিয়ায়। সেখানে তিনি স্থানীয় মানুষদের গেরিলা যুদ্ধ শেখাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি। ১৯৬৭ সালের ৮ অক্টোবর বলিভিয়ার সেনারা তাঁকে ধরে ফেলে। পরদিন ৯ অক্টোবর, তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। বয়স তখন মাত্র ৩৯ বছর।
চে তাঁর আদর্শের মাধ্যমে বেঁচে আছেন এখনো। তাঁর ছবি আজও পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত প্রতীক। তাঁর লেখা ‘দ্য মোটরসাইকেল ডায়েরিজ’ বইটি পড়লে বোঝা যায়, তিনি কীভাবে এক মেডিকেল ছাত্র থেকে বিপ্লবীতে পরিণত হয়েছিলেন। সিনেমা, বই, পোস্টার সব জায়গায় তিনি আজও অনুপ্রেরণা। চে বলেছিলেন, ‘বিপ্লবী হওয়া কঠিন, কিন্তু মানুষের প্রতি ভালোবাসা থাকলে সবই সম্ভব।’
চে গুয়েভারা ছিলেন এমন একজন ডাক্তার, যিনি শুধু শরীরের রোগ নয়, সমাজের রোগও সারাতে চেয়েছিলেন। তিনি হেরেছেন অনেক যুদ্ধে, কিন্তু হেরে যাননি তাঁর বিশ্বাসে। তাঁর জীবনের শিক্ষা খুব সহজ—অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াও, ভালোবাসা থেকে কাজ করো, সাহস হারিয়ো না। তুমি যদি কখনো অন্যায় দেখো, মনে রেখো চে–ও একসময় তোমার মতোই ছোট ছিল। কিন্তু সাহস আর ভালোবাসা তাঁকে ইতিহাসে অমর করে তুলেছে।
সভাপতি, ক্যামব্রিয়ান বন্ধুসভা