তাও তে চিং: প্রাচীন চীনা জীবনদর্শন
‘তাও তে চিং’ চীনা সভ্যতার এক প্রভাবশালী দার্শনিক রত্ন, যা তাওবাদ (Taoism) ধর্ম ও দর্শনের মূল ভিত্তি। এর রচয়িতা হিসেবে প্রচলিত নাম লাওজি। যদিও তার ঐতিহাসিক অস্তিত্ব, জীবনী ও রচনার সময় সম্পর্কে গবেষকদের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিতর্ক আছে। কেউ বলেন, তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ছয় শতকের একজন বাস্তব দার্শনিক। আবার অনেক পণ্ডিত মনে করেন, এটি নানা যুগের প্রজ্ঞাবাণ চিন্তার সংকলন। তবু সত্য একটাই, এই গ্রন্থ চীনা চিন্তা-ঐতিহ্যের শিরোমণি, যা যুগে যুগে মনন, সাধনা ও নীতিচিন্তাকে পথ দেখিয়েছে। এই বই প্রায় ২ হাজার ৫০০ বছরের পুরোনো।
‘তাও’ মানে পথ; কিন্তু এমন পথ, যা ভাষায় ধরা যায় না। ‘তে’ মানে গুণ, যা মানুষের অভ্যন্তরীণ শক্তিকে জাগায়। আর ‘চিং’ মানে গ্রন্থ, যা পথ ও গুণ উভয়কে ধারণ করে। ৮১টি ছোট অধ্যায়ের এই গ্রন্থ আজও পৃথিবীর অন্যতম বেশি অনূদিত, আলোচিত ও ধ্যান-দর্শনের ভিত্তি হয়ে আছে।
‘তাও তে চিং’-এর মূল ভাবনা ও আখ্যান
১. চিরন্তন ও অপরিবর্তনীয় পথ: ‘তাও তে চিং’-এর প্রথম অধ্যায়ে বলা হয়েছে, ‘যে তাও বলা যায়, তা চিরস্থায়ী নয়।’ অর্থাৎ প্রকৃত সত্য বা পথ ভাষায় বা চিন্তায় সীমাবদ্ধ নয়। তাও হলো সৃষ্টির মূল স্রোত, যা সবকিছুর অন্তর্নিহিত শক্তি ও নিয়ম। এটি চিরন্তন, অদৃশ্য এবং সর্বব্যাপী।
২. নীরবতা ও শূন্যতার গুরুত্ব: ‘তাও তে চিং’ অনুযায়ী নীরবতা ও শূন্যতাকে জীবন ও জ্ঞানের মূল বলে ধরা হয়। লাওজি বা যিনিই রচনা করুন না কেন, তিনি বলেন, ‘শূন্যতা দিয়ে একটি ঘর তৈরি হয় এবং নীরবতা দিয়ে জীবন পূর্ণ হয়।’ অর্থাৎ শূন্যতা ও নীরবতা আমাদের চিন্তা ও আত্মার জন্য স্থান তৈরি করে, যা প্রকৃত জ্ঞানের উৎস।
৩. সহজিয়া জীবন ও প্রকৃতির সঙ্গে মিল: লাওজি জীবনকে সহজ, নির্ভেজাল ও প্রকৃতির সঙ্গে মিল রেখে চলার শিক্ষা দেন। অতিরিক্ত আকাঙ্ক্ষা, অহংকার ও জটিলতা থেকে মুক্ত হয়ে প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলাই প্রকৃত সুখের পথ। তিনি বলেন, ‘যে মানুষ প্রকৃতির মতো নম্র, সে কখনো পরাজিত হয় না।’
৪. নম্রতা ও নম্রতার শক্তি: ‘তাও তে চিং’-এ নম্রতা ও নম্রতার শক্তি বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়। জল নম্র হলেও সবকিছু পরাজিত করে। এই দর্শন আমাদের শেখায়, নম্রতা ও ধৈর্যই প্রকৃত শক্তি। নম্রতা হলো শক্তির প্রকৃত রূপ, যা অহংকার ও জোরের চেয়ে বেশি কার্যকর।
৫. রাজনীতি ও শাসন: লাওজি শাসকদের জন্যও ‘তাও তে চিং’-এ নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, ভালো শাসন হলো এমন, যা মানুষের ওপর চাপ সৃষ্টি করে না, যেখানে শাসক নিজেকে কম প্রকাশ করে জনগণের মধ্যে শান্তি বজায় রাখে। শাসকের উচিত জনগণের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করা, তাদের স্বাধীনতা ও স্বাভাবিক প্রবাহ বজায় রাখা।
৬. বিপরীতের ঐক্য: ‘তাও তে চিং’-এ বিপরীত শক্তির ঐক্যের কথা বলা হয়েছে, যা পরবর্তী সময়ে চীনা দর্শনে ‘ইন-ইয়াং থিওরি’ হিসেবে পরিচিত। যেমন আলো ও অন্ধকার, শক্তি ও নম্রতা, জীবন ও মৃত্যু—এসব বিপরীত শক্তি একসঙ্গে মিলেই সৃষ্টির চক্র চালায়।
৭. আত্মজ্ঞান ও আত্মোন্নতি: লাওজি আত্মজ্ঞানকে জীবনের মূল উদ্দেশ্য বলে মনে করেন। নিজেকে জানার মাধ্যমে মানুষ প্রকৃত শান্তি ও মুক্তি পেতে পারে। তিনি বলেন, ‘নিজেকে জয় করাই সবচেয়ে বড় জয়।’
‘তাও তে চিং’-এর সাংস্কৃতিক ও দার্শনিক প্রভাব
১. তাওবাদ ধর্মের ভিত্তি: ‘তাও তে চিং’ হলো তাওবাদ ধর্মের মূল গ্রন্থ, যা চীনা ধর্মীয় ও দার্শনিক চিন্তাধারার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। তাওবাদ প্রকৃতি ও মানবজীবনের সামঞ্জস্য, সহজ জীবন এবং আধ্যাত্মিক মুক্তির ওপর গুরুত্ব দেয়।
২. বিশ্বব্যাপী দার্শনিক প্রভাব: ‘তাও তে চিং’–এর দর্শন শুধু চীনা সংস্কৃতিতে নয়, বিশ্বব্যাপী দার্শনিক, আধ্যাত্মিক ও সাহিত্যিক চিন্তাধারায় গভীর প্রভাব ফেলেছে। পশ্চিমা দার্শনিক ও চিন্তাবিদেরা এই গ্রন্থ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছেন।
৩. আধুনিক জীবনে প্রাসঙ্গিকতা: আজকের জটিল ও দ্রুতগামী জীবনে ‘তাও তে চিং’-এর সহজিয়া জীবনদর্শন ও নম্রতার শিক্ষা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এটি মানসিক শান্তি, পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য এবং মানবিক সম্পর্কের উন্নতির পথ দেখায়।
‘তাও তে চিং’ হলো এক অমর দার্শনিক গ্রন্থ, যা মানবজীবনের গভীর রহস্য ও প্রকৃতির সঙ্গে মিল রেখে জীবনযাপনের পথ নির্দেশ করে। লাওজির নামে প্রচলিত এই গ্রন্থ আমাদের শেখায় কীভাবে সহজ, নম্র ও প্রকৃতির নিয়ম মেনে জীবন যাপন করতে হয়। এর আখ্যান ও দর্শন আজও আধুনিক জীবনের জটিলতা থেকে মুক্তির এক দিশারি।
তথ্যসূত্র: স্ট্যানফোর্ড এনসাইক্লোপিডিয়া অব ফিলোসফি, ব্রিটানিকা, পেঙ্গুইন ক্ল্যাসিকস, ইউনেসকো মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড।