জীবনের শুরুতে কেউই ভাবে না যে একদিন শৈশবকে সে মাপতে শিখবে শূন্যতার মধ্যে। আজ আমি ২২ বছরের এক তরুণ। শৈশব শেষ হয়েছে অনেক আগেই। ছেলেবেলার এক বিকেল জীবনটাকে পুরোপুরি পাল্টে দেয়। তখন আমার বয়স আট বছর, মা–বাবার তীব্র ঝগড়া কান্না চেপে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। শেষে যখন তাঁরা আলাদা হয়ে গেলেন, আমার ভেতর থেকে ভেঙে গেল পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়—পরিবার।
প্রথম দিকটায় মা-ই ছিলেন ভরসা। তাঁর সঙ্গে প্রায় দেড় বছর থেকেছি। ভাগ্য সেদিনও আমার পেছনে দাঁড়িয়ে হাসছিল। দাদু মারা যাওয়ার পর সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল। নানা কারণে আমাকে বাবার কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হলো। তখন বুঝিনি, কিন্তু সেই মুহূর্তেই আমার জীবনের পথ যেন এক অনিশ্চিত পথে যাত্রা শুরু করল।
বাবা আমাকে ভর্তি করালেন মাদ্রাসায়। সবার আশা ছিল, একদিন হাফেজ হব। কিন্তু সেই ছোট্ট আমি যতই চেষ্টা করেছি, কোরআন মুখস্থ করতে পারিনি। সহপাঠীরা যখন একে একে অগ্রসর হচ্ছিল, আমি থেকে যাচ্ছিলাম পিছিয়ে। আমার ভেতরে কেমন এক অপূর্ণতা জমা হচ্ছিল। হয়তো আমি চাইতাম, কেউ এসে আমার কাঁধে হাত রেখে বলুক, ‘ভয় পেয়ো না, তুমি পারবে।’ সেই সান্ত্বনার হাত আমার জন্য কখনো কেউ বাড়িয়ে দেয়নি।
নিজের মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ আর হয় না, বছরের পর বছর কেটে যায়। কেমন যেন অপরিচিত হয়ে গেছেন তিনি আমার জীবনে।
মাদ্রাসা–অধ্যায় শেষ হয়ে গেলে ভর্তি হলাম সাধারণ শিক্ষার ধারায়। নতুন বই, নতুন পাঠ, নতুন পরিবেশ। কিন্তু এক জিনিস আগের মতোই রয়ে গেল, মনের ভেতরের হাহাকার। এবার জীবনে এল আরেক চরিত্র—সৎমা। শুরুতে আমাদের মধ্যে দূরত্ব ছিল। এক টেবিলে খাওয়ার সময়ও মনে হতো, দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে। আমি ভাবতাম, তিনি শুধু বাবার স্ত্রী, আমার আপন কেউ নন।
সময় ধীরে ধীরে বদলে দিল সেই অনুভূতি। মাধ্যমিক পাস করার পর পড়াশোনার জন্য যেতে হলো অন্য এক শহরে। অচেনা পরিবেশ, একা থাকার ভয়, আর নিজের ভবিষ্যতের প্রশ্নচিহ্ন প্রতিমুহূর্তে দম বন্ধ করে তুলছিল। ঠিক তখনই সৎমা হয়ে উঠলেন আমার নীরব আশ্রয়। ফোনে খোঁজ নেওয়া, কেমন আছি জিজ্ঞাসা করা, টাকার অভাবে পড়লে সাহায্য পাঠানো—সবকিছু আমাকে নতুন করে ভাবতে শিখাল। বুঝলাম, রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও আপন হয়ে ওঠা যায় মায়া দিয়ে।
অন্যদিকে নিজের মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ আর হয় না, বছরের পর বছর কেটে যায়। কেমন যেন অপরিচিত হয়ে গেছেন তিনি আমার জীবনে। মাঝেমধ্যে মনে হয়, হয়তো তিনিও আমাকে ভুলে গেছেন। এই এক শূন্যতা বুকের ভেতর পাথরের মতো চেপে বসে থাকে।
মাধ্যমিক পাস করার পর অনেক চেষ্টা করেছি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার। সেনাবাহিনী, পুলিশ, নেভি—যখন যেখানে সুযোগ এসেছে, চেষ্টা করেছি। প্রতিবারই ব্যর্থ হয়ে ফিরেছি। হয়তো নিয়তির লিখন এমন। এক-দুবার হলে বোঝা যেত ভাগ্যের খেলা, কিন্তু বারবার ব্যর্থতা আমাকে ভেতরে–ভেতরে ভেঙে দিচ্ছে।
আজ আমি ২২ বছরের এক তরুণ, অথচ মনে হয়, বহু প্রাচীন ক্লান্ত পথিক। জীবনকে বুঝতে গিয়েই বুঝে ফেলেছি, ভেতরে কত অসমাপ্ত অধ্যায় পড়ে আছে। স্বপ্ন আছে, চেষ্টা আছে, কিন্তু বাস্তবের দেয়াল এতই উঁচু যে তা টপকাতে গিয়ে প্রতিবারই পড়ে যাচ্ছি।
রাতে বিছানায় শুয়ে ভাবি, যদি মা–বাবা একসঙ্গে থাকতেন, তাহলে হয়তো জীবন অন্য রকম হতো। হয়তো কোনো সফল জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতাম। কিন্তু সেই ‘হতো’ আমার জীবনকে গিলে খায়। শুধু জানি, যেসব সম্পর্ক ভাঙে, তার ভাঙনের শব্দ সবচেয়ে বেশি কানে বাজে সন্তানের।
তবু হার মানতে চাই না। জানি, আমার গল্প এখনো শেষ হয়নি। হয়তো আমি সেই ছেলে, যার শৈশব ছিন্নভিন্ন হয়েছে, কৈশোরে ভরসাহীন থেকেছে, আর যৌবনে এসে ব্যর্থতার ভার বইছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, একদিন হয়তো এই অসমাপ্ত জীবনেই কোনো পূর্ণতা খুঁজে পাব।
তাই আজও লিখে রাখি, অসমাপ্ত জীবন আমার, যার শেষ পৃষ্ঠা এখনো খালি। হয়তো আগামীকাল, হয়তো পরদিন, কিংবা আরও কিছু বছর পর সেই খালি জায়গাটা ভরে উঠবে সফলতার আলোয়।
প্রশিক্ষণ সম্পাদক, ঠাকুরগাঁও বন্ধুসভা