রেললাইনের বাঁকে
আগুনে কাঠ-কয়লা পোড়ার শব্দ, লেলিহান শিখা, একপাশে চায়ের বড় কেতলির নলের ধোঁয়া, অপর পাশে নানরুটির চুল্লি থেকে কুণ্ডলি পাকিয়ে শুভ্র বর্ণের ধোঁয়া উড়ছে। ট্রেন পর্যটক এক্সপ্রেস ছুটে আসছে প্রবলগতিতে। কাকডাকা ভোরে হাঁটতে হাঁটতে পটিয়া রেলওয়ে বুকস্টলে যাওয়া হয় পত্রিকা সংগ্রহ করার জন্য। প্ল্যাটফর্মে নাক ডেকে কিছু শ্রমজীবী মানুষ মনের আনন্দে ঘুমাচ্ছে, কিছু যাত্রী ট্রেন থেকে নেমে হেঁটে যাচ্ছে। রাস্তার পাশে দু-একটি কুকুর শুয়ে আছে।
স্টেশনের পাশে গাউছিয়া হোটেল। ময়দার কাঁচা নানটি কাপড়ের পোটলার ওপর দিয়ে খুব শৈল্পিকভাবে গোল করে জ্বলন্ত চুল্লির ভেতর হাত দিয়ে ধুপধাপ করে বেলে দিচ্ছেন আলম ভাই। নান হয়ে গেলে লোহার শিক দিয়ে টেনে টেনে বেরও করে আনছেন। কী সুন্দর হলদে রঙের নানগুলো বলের মতো ফুলে উঠেছে। পাশে হোটেল বয়রা গরম নান প্লেটে নিয়ে গ্রাহকদের পরিবেশন করতে ব্যস্ত। ‘ওগ গা ডাল ল, এক পরোটা ভাজি, এক ডিম পোচ, তিন অ চা ল’ বলে হোটেল বয়দের চিৎকার–চেঁচামেচি। দারুণ ব্যস্ত আলমের হোটেল। ম্যানেজার চিৎকার করছে, ‘বিল কত?’
মানুষের ক্ষণিক জীবনটা যেন রেললাইনে ছুটে যাওয়া পর্যটক এক্সপ্রেসের মতো! এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত অবিরত ছুটে চলা কেউ তাঁর জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে, কেউ হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়।
নুরুল আলম হোটেলের মালিক। মাঝেমধ্যে নান বানানোর কারিগর না এলে আলম নিজেই নান বানানো চুল্লির ধারে গিয়ে রুটি বানান। বেচারার কপাল ঘেমে একাকার, গামছা দিয়ে মুখ মুছতে ব্যস্ত। আলম আমাকে দেখে সালাম দিয়ে বললেন, ‘ভাইজান, কবে এলেন ঢাকা থেকে?’ তারপর আমার হাত ধরে হোটেলের কেবিনে নিয়ে গেলেন। হোটেল বয় গরম পরোটা আর ধোঁয়া–উড়িত চা নিয়ে এল। চায়ের মগে পরোটা চুবিয়ে খেতে খেতে আলম ভাই তাঁর জীবনের গল্প শুরু করলেন, কীভাবে শুরু করলেন হোটেল ব্যবসা।
এই ফাঁকে আমি তাঁকে বললাম, আপনি তো এখন পটিয়ার মানবিক মানুষ ‘নিষ্পেষিত মানুষের বন্ধু’।
‘বয়স তখন সাত-আট হবে। অভাবের সংসার তিনবেলায় একবেলাও খাবার জুটত না। একমুঠো ভাতের অভাবে খালি পেটে কতবার স্কুলে গেছি, হিসাব নেই। কাজ করতে গিয়ে দেরিতে ক্লাসে যাওয়ায় শিক্ষকের বেতের বাড়িও হজম করতে হয়েছে। টেনেটুনে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেছি। বাড়িতে নুন আনতে পান্তা ফুরায়। পরিবারের হাল ধরতে বাবার সঙ্গে কুলির কাজ, কখনো দিনমজুরের কাজও করেছি। যা আয় হতো, বাবার হাতে তুলে দিতাম। ছোট ভাই আবুল কালাম ও আবুল কাশেম এবং আদুরে বোন ছিল, ওদের মুখে হাসি ফোটাতে কর্মব্যস্ত কেটেছে ছেলেবেলা।
‘একসময় গলায় পানের ডালা ঝুলিয়ে পান, চকলেট বিক্রি করেছি। ফুটপাতে বসে পেয়ারা, আইসক্রিম, পেপার কত কী যে বিক্রি করেছি। বাসে উঠতাম চকলেট, আইসক্রিম, আমড়া- শসা বিক্রি করতে, গাড়ির ড্রাইভার-হেল্পাররা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। বাস থেকে পড়ে গিয়ে হাতে চোট লাগে, ফুটপাতে পুলিশের লাঠির বাড়িও কত খেয়েছি। পরে তো হোটেলে চাকরি নিলাম। একেবারে হোটেলের হাঁড়ি–পাতিল, কাপ-প্লেট ধোয়া–মোছা থেকে রুটি, চা বানানো সবকিছু করতাম। একসময় পাকা রন্ধনশিল্পী বনে গেলাম।’
টাকাপয়সা জমিয়ে একসময় মামার হাত ধরে হোটেল ব্যবসা শুরু করেন নুরুল আলম। ছোট পরিসরে শুরু করেছিলেন। অনেক চড়াই-উতরাই ও পরিশ্রমের পর একসময় গাউছিয়া হোটেলের মালিক বনে যান। হোটেলে কর্মচারী আছে ১৫ জনেরও বেশি।
একসময় একসঙ্গে দুই-তিন শ টাকা হলে খুশিতে, আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেতেন আলম। এখন লাখ লাখ টাকার মালিক। অনেকেই তাঁকে চেনে গরিবের বন্ধু হিসেবে। আলমের বাবার নির্দেশ ছিল, কখনো হোটেলে গ্রাহকদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা যাবে না, ভালো ব্যবহার করতে হবে। গ্রাহক দোকানের বরকত। কোনো গ্রাহককে ঠকানো যাবে না। গ্রাহকদের হোটেলে প্রবেশ করামাত্রই সালাম দিতে হবে। যতই বেচাবিক্রি থাকুক, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে হবে। সততা ও নীতি ঠিক রেখে মানসম্মত নির্ভেজাল খাবার পরিবেশন করতে হবে। বাবার শিখিয়ে যাওয়া উপদেশ সব সময় মেনে চলেন আলম। একটা উপদেশ ছিল, ‘হোটেলে গরিব, ফকির-মিসকিন এলে ওদের যেন খালি হাতে ফিরিয়ে দেওয়া না হয়। ওরা মেহমান, ওরা ওদের রিজিক নিয়ে আসে। কখনো অতীত ভুলো না। মনে রেখো, দানে সম্পদ বাড়ে। অসহায়দের দান করলে স্বয়ং আল্লাহ খুশি হন। অনাহারীদের খাবার দিয়ো।’
আলম বলেন, ‘বাবা বেঁচে নেই। অনেক কষ্ট করে নিজে না খেয়ে, না পরে সন্তানদের মানুষ করেছেন। আল্লাহ আমাদের অনেক টাকাপয়সা ধনদৌলত দিয়েছেন। কোনো কিছুর অভাব নেই, সব আছে, কিন্তু বাবা নেই।’ আলম ভাই এ কথা বলতেই তাঁর চোখের জল গড়িয়ে পড়ল চায়ের কাপে।
একসময় তাঁদের পরিবারে ভালো খাবার জুটত না। ঈদে ছোট ভাইবোনদের নতুন জামা কিনে দিতে পারেননি। আলম এখন সপ্তাহে এক দিন নিষ্পেষিত মানুষদের ফ্রি খাওয়ান। প্রতি শুক্রবার ফকির-মিসকিন লোকেরাই হয় তাঁর হোটেলের মেহমান। ১৫০ থেকে ২০০ গরিব লোকের খাবারের আয়োজন হয়। ২৮ বছর ধরে হোটেলটি তিন ভাই মিলেমিশে পরিচালনা করে আসছেন।
মানুষের নীতি ও লক্ষ্য ঠিক রেখে পরিশ্রম করলে সফলতা এসে ধরা দেয়। আলমের উত্থানের গল্প শেষে চায়ের মগে শেষ চুমুক দিয়ে বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। রেলস্টেশনের পাশে এক বাউল সুরেলা কণ্ঠে গান করছিল, ‘রিকশাওয়ালা বলে কারে তুমি আজ ঘৃণা করো, কুলি-মজুর বলে কারে তুমি আজ ঘৃণা করো, কিষান বলে কেন হেলা করো, শ্রমিক বলে কেন এড়িয়ে চলো...।’ রেলস্টেশনে অনেক পথচারী শিল্পীর চারদিকে বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গান উপভোগ করছে। গানের কথাগুলো যেন হৃদয় ছুঁয়ে গেল।
মনে মনে ভাবছিলাম, মানুষের ক্ষণিক জীবনটা যেন রেললাইনে ছুটে যাওয়া পর্যটক এক্সপ্রেসের মতো! এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত অবিরত ছুটে চলা কেউ তাঁর জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে, কেউ হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। আলম তাঁর জীবনে বারবার হোঁচট খেয়েছেন, নিজের চেষ্টায় উঠে দাঁড়িয়েছেন, কখনো হামাগুড়ি দিয়েছেন, কখনো হেঁটেছেন, কখনো দৌড়েছেন দুর্বারগতিতে ছুটে যাওয়া ট্রেনের মতো। এখন তিনি সফলতার চূড়ায় পৌঁছেছেন।
কানে ভেসে আসছিল, ‘অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে পর্যটক এক্সপ্রেস কক্সবাজারের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে।’ আমি রেললাইনের বাঁকে হাঁটতে শুরু করলাম।
উপদেষ্টা, পটিয়া বন্ধুসভা