সবুজ ঢেউখেলানো উপত্যকায়

বরফ ও পাহাড়ের দিক থেকে গুলমার্গ ও সোনমার্গ প্রায় একই রকম
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

গুলমার্গের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। হোটেলে ফিরতে হলো বেশ রাত করে। পরের দিনের যাত্রা সোনার তূণভূমি। এখানে এক সোনালি জলের কূপ থাকার কথা প্রচলিত আছে। যে কারণে এ জায়গার নাম হয় সোনমার্গ।

কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর থেকে প্রায় ৮৭ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে এই সোনমার্গ। এখানে রাস্তার দুই পাশে, কাছে, দূরে এত পাহাড়—যেতে যেতে মনে হলো, নিউইয়র্কে যেমন জাতিসংঘের সদর দপ্তর, তেমনি কাশ্মীর হলো পৃথিবীর পাহাড়ের সদর দপ্তর। এই দপ্তরে পাহাড়ে পাহাড়ে বৈষম্য, পাহাড়ের প্রতি মানুষের অত্যাচার, পৃথিবীতে তাদের টিকে থাকার অধিকার নিশ্চিত হচ্ছে কি না, সব যেন এখান থেকে নিশ্চিত হয়। জীবনে এত পাহাড় এক জায়গায় কখনো দেখা হয়নি। আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছে যেন ঘোমটা পরা লজ্জাবনত পর্বতমালা। কাশ্মীর ভ্রমণে এ পর্যন্ত অনেক পাহাড় দেখা হলো। কিন্তু সোনমার্গের একেকটি পাহাড় যেন একেকটি মায়া।

ভূস্বর্গের সেরা আকর্ষণ সোনমার্গ
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

শুধু পথের টানেই
বরফ ও পাহাড়ের দিক থেকে গুলমার্গ ও সোনমার্গ প্রায় একই রকম। তবে অন্য বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে ভূস্বর্গের সেরা আকর্ষণ সোনমার্গ। শ্রীনগর থেকে কারগিল হয়ে সোজা রাস্তা গেছে লাদাখের পথে। চলার সময় দেখা যাবে পাহাড়ের স্বর্ণচূড়া। সিন্ধু নদীর স্রোত। তবে এটা ছোটবেলায় বইয়ে পড়া সেই সিন্ধু নদ নয়। সোনমার্গের একটি পাহাড়ি অপূর্ব নদীর নাম সিন্ধু। এর সৌন্দর্য আত্মহারা করে দেয়। শুধু পথের টানেই সোনমার্গ যাওয়া যেতে পারে। পুরো পথই আকর্ষণীয়। চোখ ফেরানো কঠিন। রাস্তার দুই পাশে কাঠবাদাম ও চেরিগাছের সারি যে কাউকে আপন করে নেবে।

আরও পড়ুন

একসময় পৌঁছে গেলাম সোনমার্গ। সোনমার্গও জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র। এটি একটি দীর্ঘ উপত্যকা। এর পাহাড়ি ঢালে রয়েছে কাশ্মীরের গ্রাম। গাড়ি থামল পাহাড়ে ঘেরা এক সবুজ ঢেউখেলানো উপত্যকায়। এখানে সুন্দর হিমবাহ আছে। সেখানে ঘোড়ায় চড়ে ও হেঁটে যাওয়া যায়। হিমবাহের পাশে আছে শুকনা জায়গা। এটা হলো মানুষ ঘোড়ার ল্যান্ডিং। পর্যটকেরা ঘোড়ায় চড়ে এখানে নামেন। ফায়ারপ্লেস আছে। ঠান্ডায় হাত-পা জমে গেলে আগুনের পাশে বসা যায়। নানা প্রজাতির বাদাম ও মসলা দিয়ে বানানো ‘কাওয়া’ নামে এক ঐতিহ্যবাহী চা–সহ নানা খাবার রয়েছে।

এটি একটি দুর্দান্ত ল্যান্ডস্কেপ। ফটোগ্রাফারদের স্বর্গরাজ্য। আসলে ভূস্বর্গ তো স্বর্গই। দূরে কিছু পর্বত ধূসর, কিছু সবুজ, কিছু তুষারাবৃত। এখানে বরফে মোড়া পাহাড়চূড়ার রূপ সবকিছু ভুলিয়ে দেয়। এখানেও পর্যটকেরা সাদা গালিচার মতো বরফের আনন্দ নিতে পারে। তুষারময় পাহাড়ের পেছনে থাকে নীলাকাশ। এ এক সীমাহীন আনন্দ। মনে হয় যেন জীবনে আর কিছু চাওয়ার নেই।

দূরে কিছু পর্বত ধূসর, কিছু সবুজ, কিছু তুষারাবৃত
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

সোনমার্গের ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। একসময় এটা সিল্ক রোডের প্রবেশদ্বার ছিল। এই সিল্ক রোড কাশ্মীরকে চীনসহ উপসাগরীয় দেশের সঙ্গে যুক্ত করেছিল।

‘আগার ফেরদৌস বে-রোহী যামীন আস্ত্, হামীন আস্ত্, হামীন আস্ত্, হামীন আস্ত্’, অর্থাৎ পৃথিবীতে যদি কোনো বেহেশত থাকে, তবে তা এখানে, এখানে, এখানে। ফারসি ভাষায় এ কথা বলেছিলেন মোগল বাদশাহ জাহাঙ্গীর। কাশ্মীরকে তিনিই প্রথম স্বর্গের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।