পাহাড়ের বিশালতার সৌন্দর্যে বন্ধুত্বের বন্ধন। বৃষ্টি, ঝরনা, ঝিরি, জুমঘর, পাহাড়ের চূড়া, আকাশের লাল আভা, হঠাৎ রংধনু—এমন আরও চমৎকার সব দৃশ্যের সঙ্গে মিতালি করতে ড্যাফোডিল বন্ধুসভা আয়োজন করে বার্ষিক ভ্রমণ ‘পাহাড়ের মাঝে বন্ধুত্বের বন্ধনে’।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাত ১১টায় রাজধানীর কল্যাণপুর বাসস্টান্ড থেকে শুরু হয় যাত্রা, গন্তব্য বান্দরবানের মিরিঞ্জা ভ্যালি। যাত্রাপথে বাসের মধ্যে আড্ডা, গান, ছবি তোলা এবং নানা পরিকল্পনা শুরু করে দেন বন্ধুরা। রাস্তায় জ্যাম থাকায় বাস চলছিল ধীরে ধীরে। পরদিন বেলা সাড়ে ১১টায় পৌঁছাই কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায়।
চকরিয়া বাজার থেকে চাঁন্দের গাড়িতে করে যেতে হবে গন্তব্যে। পাহাড়ি রাস্তা হওয়ায় নিরাপত্তার জন্য সেনাবাহিনীর চেকপোস্টে সবার জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি জমা দিতে হয়। যাঁদের ফটোকপি সঙ্গে নেই, তাঁরা বাজার থেকে ফটোকপি করতে ব্যস্ত হয়ে যায়। এরই মধ্যে উপস্থিত হন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাই আশরাফুল ইসলাম। তিনি চকরিয়ার স্থানীয়। কথাবার্তা বলে চাঁন্দের গাড়িও ভাড়া করে ফেললেন।
সবাই চাঁন্দের গাড়িতে উঠে পড়েন। আশরাফুল ভাই আমাদের নিয়ে যান তাঁর রেস্তোরাঁয় সকালের নাশতার জন্য। দুটি গাড়ি ছুটে চলল ওনার বাইকের পেছনে, একসময় পৌঁছে গেলাম ঝিলমিল ক্যাফে ও লাউঞ্জে। সকালের নাশতা শেষে উনি সবাইকে আইসক্রিমও খাওয়ালেন। এ সময় ভাইকে বন্ধুসভার পক্ষ থেকে একটি টি-শার্ট উপহার দেন সভাপতি নাজমুল হাসান ও সাধারণ সম্পাদক জাকিয়া লিমা।
এরই মধ্যে জুমার নামাজের সময় হয়ে যায়। নামাজ শেষে চাঁন্দের গাড়িতে করে গন্তব্যের পথে যাত্রা। বন্ধুরা মেতে উঠল গানের কলি খেলায়, সবার চোখে সবুজ শ্যামল পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখার উচ্ছ্বাস। বেলা তিনটায় পৌঁছে যাই মিরিঞ্জা ভ্যালি। উঠলাম দোতং রিসোর্টে। সেখানেই তিনটা জুমঘর। তিনটাই আমাদের জন্য আগে থেকেই বুকিং দেওয়া ছিল।
পৌঁছাতেই রিসোর্টের ব্যবস্থাপক দীপা আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। ওনার সঙ্গে আগে থেকেই পরিচয় ছিল আমাদের এক বন্ধুর। আগে থেকেই তিনি দুপুরের খাবার প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। মাচায় বসে চলল খাবার পর্ব। আয়োজনে ছিল মুরগি, ভাত, ডাল, পাহাড়ি সবজি ও চিকেন লাক্সা।
খাওয়া শেষে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বিকেল সাড়ে চারটায় বের হই ঝরনা দেখার উদ্দেশ্যে। সাহাদ নামের একটা ছোট্ট ছেলে গাইড হিসেবে আমাদের সঙ্গে যায়। ওর পেছনে হাঁটতে হাঁটতে আর চারপাশের পরিবেশ দেখতে দেখতে ছুটে চলল বন্ধুদের কাফেলা। এত লম্বা জার্নির পরও কারও শরীরে ক্লান্তির কোনো ছাপ নেই। পাহাড়ি পথ পেরিয়ে, ঝিরিপথ হেঁটে সূর্য অস্ত যেতে যেতেই পৌঁছে গেলাম ঝরনায়। ঝরনার পানিতে গোসল করে বেশি অন্ধকার হওয়ার আগেই আবার ফিরে আসি রিসোর্টে।
রাত আটটার দিকে হাজির দীপার তৈরি ঝালমুড়ি। সবাই একসঙ্গে খেতে খেতে শুরু হলো আড্ডা ও পরিচয় পর্ব। আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন সাবেক সভাপতি এহসানুল হক ফেরদৌস ও সাব্বির আহমেদ, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আশিকুর রহমান ও জান্নাতুল মলি, সাবেক সহসাংগঠনিক সম্পাদক শাহিদ খান ও সাবেক সদস্য নাজমুল হিমেল। তাঁরা বন্ধুদের উদ্দেশে বিভিন্ন দিকনির্দেশনামূলক কথা বলেন। পরে গানবাজনা, হাসিঠাট্টায় মেতে ওঠেন সবাই।
এরই ফাঁকে বারবিকিউর আয়োজন শুরু হয়ে যায়। মুরগির ঘ্রাণে, আর পাহাড়ের সৌন্দর্যে পরিবেশ জমে ক্ষীর। পাহাড়ি শীতল বাতাস, মনমাতানো আবহাওয়া সবাইকে মুগ্ধ করে। খাওয়াদাওয়া শেষে কেউ ফিরে যায় আড্ডায়, কেউবা ঘুমিয়ে পড়ে। এভাবেই রাত কেটে যায়, ভোরের পাখিরা ডাকা শুরু করে, সূর্যি মামা উঁকি দেয়।
ভোরের অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করতে দ্রুত ঘুম থেকে উঠে পড়েন বন্ধুরা, সেজেগুজে প্রস্তুত হন সৌন্দর্যের সঙ্গে নিজেকে ফ্রেমে বন্দী করতে। এবার গন্তব্য আলিরগুহা, আলিকদম, লামা, বান্দরবান। বেলা ১১টার মধ্যে রিসোর্ট ছেড়ে রওনা হয়ে যাই।
চাঁন্দের গাড়িতে করে আলিকদমের পথে। পানবাজার পৌঁছালে আমাদের সঙ্গে গাইড হিসেবে যুক্ত হন সেলিম ভাই। দুপুরের মধ্যে আলিরগুহা ঘুরে শেষ করতেই সেলিম ভাই আমাদের নিয়ে গেলেন এক ভয়ানক পাহাড়ি পথে, অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য, মেঘ ঘেঁষে বের হচ্ছে পাহাড় আমাদের চোখের সামনে থেকে। প্রায় দুই ঘণ্টা পাহাড়ি উঁচু-নিচু পথ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম খৈয়ার ঝিরি পাড়া, আলিকদম। রাস্তা থেকে কিছু দূর হাঁটতেই দেখা গেল এক অপরূপ বিস্ময়! পাহাড়, ঝিরি, নীল রাঙা পাথর। সঙ্গে সঙ্গে নেমে এল বৃষ্টি। সবাই মিলে বৃষ্টি উপভোগ করলাম।
ঝিরিতে ঝরনার পানির স্রোত খুব দ্রুত বেড়ে চলায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও সাবধানতা অবলম্বনে বিদায় নিলাম খৈয়ার ঝিরি পাড়া থেকে। আলিকদমের পানবাজার আসতে আসতে সন্ধ্যা ৬টা। সেখানে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম সবাই। সেখান থেকে বিদায় নেন সেলিম ভাই।
রাত আটটার দিকে আমরা আবার ফিরে যাই রিসোর্টে। সেখানে দীপা বিদায়কালে বললেন, ‘পাহাড়ের সৌন্দর্য অপরূপ এবং অমূল্য। কিন্তু পর্যটকেরা এসে আমাদের পাহাড়ের পরিবেশ নষ্ট করে, আমাদের সঙ্গে বাজে আচরণ করে। তবে ড্যাফোডিল বন্ধুসভার বন্ধুরা অতি মার্জিত ব্যবহারের পরিচয় দিয়েছেন। আপনাদের আবারও আমাদের রিসোর্টে দাওয়াত রইল।’
রিসোর্ট থেকে গোসল করে, জামাকাপড় বদলে ব্যাগ নিয়ে আবারও চকরিয়া বাজারের উদ্দেশে রওনা হই। এবার ঢাকায় ফেরার পালা। রাত ১০টার মধ্যে পৌঁছে যাই ঝিলমিল ক্যাফেতে। সেখানে আশরাফুল ভাই আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। রাতের খাবার শেষে ছুটে চলি বাসস্ট্যান্ডে। রাত ১১টার বাস। সময়মতো বাস ছেড়ে দেয় আবারও ব্যস্ত জীবনের উদ্দেশে।
সকাল সাড়ে ছয়টায় বাস পৌঁছে যায় রাজধানীর মতিঝিলে। সেখানে নেমে বন্ধুরা যাঁর যাঁর গন্তব্যে।
ভ্রমণ সফল করতে সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন সভাপতি নাজমুল হাসান, সাধারণ সম্পাদক জাকিয়া লিমা, অর্থ সম্পাদক সাব্বির হোসেন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অদিত আল নাফিউ, সহসাংগঠনিক সম্পাদক মুসাভভির সাকির, বন্ধু রাইসুল ইসলামসহ অন্যরা।
সহসাংগঠনিক সম্পাদক, ড্যাফোডিল বন্ধুসভা