তোর জন্য পেঁপে আনার কথা ছিল রে

ছবি: এআই/বন্ধুসভা
হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে বসে বাবা কাঁধের ব্যাগ থেকে ছোট্ট একটি মোড়ক আমার হাতে দিলেন। জানতে চাইলে বললেন, ‘বাসায় গিয়ে দেখিস।’

বাবার হাত ধরে হাঁটছি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের পূর্ব গেট দিয়ে। গ্রাম থেকে এসেছেন ডাক্তার দেখাতে। এক যুগের বেশি সময় ধরে হেপাটাইটিস-বি ও অন্যান্য জটিল রোগ নানাভাবে কাবু করে রেখেছে। কয়েক মাস পরপর আসেন এবং সঙ্গে করে আনেন ছোট্ট মোড়কে বাঁধা মায়ের বিশুদ্ধ ভালোবাসা।

দীর্ঘদিন পর দেখা হওয়ার আনন্দে বাবা কথার ঝাঁপি খুলে বসেন। মায়ের অসুস্থতার খবর, বাড়ির চারপাশের গাছপালার ফলফলাদি, কিংবা ভিটেবাড়ির বেড়া—সবই তিনি হিসাব করে বলতে থাকেন। আমি কেবল হ্যাঁ বা হুঁ দিয়ে সাড়া দিই। কিছু বলতে গেলে গলা আটকে আসে, স্মৃতিকাতরতা গ্রাস করে।

ইদানীং লক্ষ করছি, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবার ভেতরে শিশুসুলভ আচরণ যেন বেড়ে চলেছে। ছোটবেলায় তাঁর কাছে যেতে ভয় পেতাম; অথচ এখন তিনিই আমাদের হাত ধরে পাশে থাকতে চান। শহরের তীব্র যানজটে ওনার হাত শক্ত করে ধরে রাস্তা পার হতে গিয়ে নিজেকেই যেন দায়িত্বশীল পিতা মনে হলো। ভাবলাম, জীবনের নিয়মটাই এমন—সময়ের তাগিদে এক হাতের দায়িত্ব অপর হাতে উঠে আসে নীরবে।

হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে বসে বাবা কাঁধের ব্যাগ থেকে ছোট্ট একটি মোড়ক আমার হাতে দিলেন। জানতে চাইলে বললেন, ‘বাসায় গিয়ে দেখিস।’ মোড়কটি ব্যাগে রেখে দিলাম। এরপর তিনি চশমা এঁটে রিপোর্ট পড়ার চেষ্টা করলেন। জানতাম, ওনার পক্ষে কিছুই বোঝা সম্ভব নয়। আমি পড়ে শোনালাম—অসুখ আগের মতোই আছে, ভয় নেই।

আমার কথায় বিশেষ মনোযোগ নেই ওনার; নিজের মতোই ভেবে চললেন সব। হঠাৎ আফসোস করে বলে উঠলেন, ‘তোর জন্য পেঁপে আনার কথা ছিল রে। দেখেছিস এবার? আমাদের দুজনেরই মনে ছিল না ব্যাগে ভরার। তোর মা এক ফালি পেঁপে রেখেছিল ফ্রিজে।’ বাবাকে থামিয়ে দিয়ে আমি হাসলাম—‘এখন শহরে সব পাওয়া যায়, আপনারা খেয়ে নিয়েন।’

আরও পড়ুন

যখনই বাবার অসুখ নিয়ে কথা বলতে চাই, তিনি তখনো বলেন, আমার পড়াশোনা ও ভবিষ্যতের কথা, মায়ের শারীরিক অবস্থার কথা। নিজের ব্যথা-যন্ত্রণা আড়াল করে মনোবলকে শক্ত খুঁটির মতো দাঁড়িয়ে রেখেছেন আমার সামনে। আমি নিশ্চুপে বসে থাকি, আর তাঁর দেহভঙ্গিতে ক্রমশ বাড়তে থাকা অসুস্থতার ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

সব কাজ সেরে গ্রামে ফেরার বাসে তুলে দিলাম বাবাকে। ওঠার আগে আবারও আফসোস করে বললেন, ‘এক ফালি পেঁপের কথা মনে রইল না।’

বাসায় ফিরে ব্যাগ খুলে দেখি মোড়কের ভেতর কয়েকটা কামরাঙা, দু-চারটা কাঁচাপাকা সফেদা, একটি পেয়ারা আর টুকটাক কিছু জিনিস। সেগুলো দেখে হঠাৎ ভেসে উঠল মায়ের সজল চোখের মুখ। মনে হলো—ছোট্ট মোড়কের ভেতর যেন গুঁজে দেওয়া আছে তাঁর স্নেহ–মমতা আর অনন্ত ভালোবাসা।

শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়