‘মাছরাঙা’ যেন রঙিন ডানায় জলছবির শিল্পী

শিকার মুখে নিয়ে উড়ছে সাদা বুক মাছরাঙা পাখিটি। বলরামপুর, পাবনাছবি: হাসান মাহমুদ

একঝলক দেখলেই চোখ আটকে যায়। ডালে বসে থাকা একটুকরো রং, যেন কেউ তুলি দিয়ে তার গায়ে আকাশের নীল, পাতার সবুজ আর সূর্যের কমলা ছড়িয়ে দিয়েছে। পাখিটির নাম মাছরাঙা। কিন্তু শুধু নামেই ‘মাছরাঙা’ নয়; প্রত্যেকটি ভঙ্গিতে, আচরণে এবং শিকার ধরার অভিনব কৌশলে যে গভীরতা, তা জানলে বিস্ময়ে থমকে যেতে হয়।

মাছরাঙাকে দেখা যায় জলাশয়ের ধারে, কোনো বৈদ্যুতিক তারে অথবা খোলা শাখায় একা বসে থাকতে। নড়ে না, চড়ে না—যেন প্রকৃতির এক ক্ষণস্থায়ী মূর্তি। কিন্তু পাখিটির স্থিরতা যেন বুদ্ধিমত্তার এক নিঃশব্দ ভাষা। চোখে অতিমানবীয় দৃষ্টি, নিচের স্বচ্ছ জলপৃষ্ঠে তাকিয়ে দেখে মাছের ক্ষীণ নড়াচড়া, জলের ঢেউয়ে ছায়ার প্রতিফলন থেকে বোঝে মাছ কোন দিকে মুখ করে আছে। মুহূর্তেই ঠোঁট টান হয়ে ওঠে তীরের মতো, ডানায় ধরা দেয় ঝড়। আর সঙ্গে সঙ্গেই পানির বুক চিরে নেমে আসে শিকারের দিকে। চোখের পলকে ফেরত আসে—ঠোঁটের ফাঁকে একফালি রুপালি মাছ।

এই অভূতপূর্ব শিকার দক্ষতার পেছনে রয়েছে এক জটিল শারীরবৃত্তীয় গঠন। মাছরাঙা কোরাসিফর্মিস (Coraciiformes) বর্গের অন্তর্গত অ্যালসিডিনিডি (Alcedinidae) পরিবারভুক্ত পাখি। এই পরিবারে তিনটি উপপরিবার রয়েছে—অ্যালসিডিনিডি (Alcedinidae), হ্যালসিওনাইট (Halcyonidae) ও কর্ডিলিডি (Cerylidae)। শরীর ছোট, মাথা তুলনায় বড়, ঠোঁট লম্বা ও ধারালো, যেন কাটাছেঁড়ার জন্য বিশেষভাবে নির্মিত। শিকার ধরার কৌশল শুধু গতিনির্ভর নয়, এটি এক নিখুঁত পরিকল্পনার ফল। অনেক সময় এরা পানির ভেতরে পুরো ডুব দেয়, আবার শিকারের পর গাছের ডালে ফিরে এসে সেই মাছকে ঠোঁটে বারবার আঘাত করে। তারপর মাছটিকে এরা সাধারণত এমনভাবে শূন্যে ছুড়ে গিলে ফেলে যাতে আঁশ বা কাঁটা গিলতে সমস্যা না হয়, তাই মাথা-পেছনের দিক আগে মুখে নেয়। এ যেন প্রকৃতির মঞ্চে এক নিখুঁত বাস্তব নাটক।

বিশ্বজুড়ে মাছরাঙার প্রায় ৯৪টি প্রজাতি রয়েছে, যার মধ্যে বাংলাদেশে রয়েছে ১২ প্রজাতির চোখধাঁধানো বৈচিত্র্য। এদের একেকটির রং, আকার ও স্বভাব একেবারে আলাদা। নিচে এদের কিছু উল্লেখযোগ্য পরিচয় তুলে ধরা হলো—

পোকা শিকার করে খাচ্ছে সাদাবুক মাছরাঙা পাখি। বলরামপুর, পাবনা
ছবি: হাসান মাহমুদ

ব্লাইথস মাছরাঙা (Blyth’s Kingfisher-Alcedo hercules): বাংলাদেশে যে মাছরাঙাটি অপেক্ষাকৃত বড় আকৃতির এবং কিছুটা লাজুক, তার নাম ব্লাইথস মাছরাঙা। এরা মূলত মিশ্র হরিৎ বনাঞ্চলে দেখা যায়। গায়ের রং গাঢ় নীলচে, মাথা ভারী, ঠোঁট খাড়া ও শক্ত। দেখা মেলে তুলনামূলক দূরবর্তী ও কম জনবসতিপূর্ণ এলাকায়।

ছোট নীল মাছরাঙা (Common Blue Kingfisher - Alcedo atthis): প্রায় ১৮ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের এই মাছরাঙা আমাদের দেশের সব অঞ্চলেই দেখা যায়। গায়ের উপরিভাগ উজ্জ্বল নীল, ডানার কিনারে সবুজের আভা। মাথায় কালচে নীল দাগ। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে প্রায় অভিন্ন। গ্রীষ্মের শুরুতে, অর্থাৎ মার্চ থেকে জুন, এরা খাড়া ঢালে গর্ত করে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৫ থেকে ৭টি। এদের উড়াল দ্রুত এবং তিরবেগের মতো সোজা। এলাকা রক্ষায় অত্যন্ত সচেতন।

সাদাবুক মাছরাঙা (White-breasted Kingfisher - Halcyon smyrnensis): প্রায় ২৮ সেন্টিমিটার লম্বা এই প্রজাতির মাথা, ঘাড় ও পেট গাঢ় বাদামি। বুক সাদা, ঠোঁট ও পা গাঢ় লাল। খাদ্যতালিকায় মাছের চেয়ে বেশি স্থান দখল করে পোকামাকড়, ব্যাঙ, গিরগিটি, এমনকি দুর্বল ছানা পাখিও। জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ডিম পাড়ে। স্ত্রী-পুরুষ উভয়েই বাসা তৈরিতে, ডিমে তা দেওয়া ও বাচ্চা পালনে সমান অংশ নেয়।

আরও পড়ুন

পারকা মাছরাঙা (Pied Kingfisher - Ceryle rudis): সাদা-কালো পালকে মেশানো এই মাছরাঙা যেন ধূসর ছায়ার মধ্যে নকশার আঁচড়। দৈর্ঘ্যে প্রায় ১৭ সেন্টিমিটার। উড়াল নীরব নয়—ডানার শব্দ শুনেই তার আগমন টের পাওয়া যায়।

মেঘ হও মাছরাঙা (Stork Billed Kingfisher - Halcyon capensis): প্রায় ৩৫ সেন্টিমিটার লম্বা এই মাছরাঙা দেখতে ভারিক্কি। গাছের ডালে চুপচাপ বসে থেকে হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকার ধরে। এদের ঠোঁট বেশ বড় ও লালচে, শরীরের রং বিভিন্ন শেডে বিভক্ত—নীল, বাদামি, সবুজের মিশ্রণ।

লাল মাছরাঙা (Ruddy Kingfisher - Halcyon coromanda): লম্বায় প্রায় ২৫ সেন্টিমিটার। পা ও ঠোঁট মোটা ও শক্তিশালী। গায়ের রং গাঢ় লালচে। বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, জাপান ও ভারতেও দেখা যায়।

গরমে বিশ্রাম নিচ্ছে মাছরাঙা পাখিটি। লবণচরা, খুলনা
ছবি: সাদ্দাম হোসেন

সবুজ মাছরাঙা (Collared Kingfisher - Todiramphus chloris): গেছো প্রকৃতির এই মাছরাঙা হ্যালসিওনিডি (Halcyonidae) পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। এদের পালকে সাদা ও সবুজের দারুণ সমন্বয়। উপকূলবর্তী অঞ্চলে এদের দেখা মেলে বেশি।

বাদামি মাছরাঙা (Brown-winged Kingfisher - Pelargopsis amauroptera): বিশাল লাল ঠোঁট, বাদামি ও ফ্যাকাশে নীলের ছোঁয়ায় গড়া গঠন। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ জঙ্গলই এদের প্রধান আবাসস্থল।

কালো মাছরাঙা (Black-capped Kingfisher - Halcyon pileata): সুন্দর কালো টুপি মাথায়, লাল ঠোঁট ও চোখ ধাঁধানো রং। এদেরকে প্রধানত সেন্ট মার্টিন ও উপকূলীয় অঞ্চলে দেখা যায়।

বুনো মাছরাঙা (Oriental Dwarf Kingfisher - Ceyx erithacus): এই মাছরাঙার রং যেন এক স্বপ্নের ক্যানভাস—নীল, বেগুনি, কমলা ও হলুদ মিশে এক অপার্থিব সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। তিন আঙুলবিশিষ্ট এই পাখি দেখতে যেমন লোভনীয়, তেমনি বিরল।

পাখি, প্রকৃতি ও আমরা
মাছরাঙারা শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, এরা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ, বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য রক্ষা—সবকিছুতেই পাখির অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু আজ মানুষ নিজের প্রয়োজনে বন কাটছে, জলাশয় ভরাট করছে, পাখিদের আবাস কেড়ে নিচ্ছে।

মাছরাঙার মতো একটি সুন্দর ও দরকারি পাখি যদি হারিয়ে যায়, তবে তার দায় আমাদেরকেই নিতে হবে। তাই প্রয়োজন এই প্রজাতিগুলোর জন্য সংরক্ষিত অঞ্চল তৈরি, জলাশয় সংরক্ষণ, সচেতনতা বৃদ্ধি ও পাখি শিকার বন্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ। প্রকৃতির এই রঙিন শিল্পীদের রক্ষা করা মানে নিজেদের অস্তিত্বকেও রক্ষা করা। আর মাছরাঙার চোখে যেমন ধৈর্যের দীপ্তি, আমাদের দায়িত্বেও থাকা উচিত সেই ধৈর্যের প্রতিফলন—নীরবতাতেও সক্রিয় সজাগতা।

শিক্ষার্থী, ঝালকাঠি এন এস কামিল মাদ্রাসা, ঝালকাঠি