সৌন্দর্যের প্রতীক প্রজাপতি

একদল রঙিন প্রজাপতি লতায় বসে আছে। কামিলা ছড়ি, রাঙামাটিছবি: সুপ্রিয় চাকমা

প্রকৃতির রঙিন রূপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মোহনীয়, সবচেয়ে আকর্ষণীয় যদি কিছু থাকে, তা নিঃসন্দেহে প্রজাপতি। ছোট্ট এই পাখায় যেন লুকিয়ে আছে একেকটি ক্যানভাস। শিল্পীর তুলি, কবির ছন্দ, লেখকের শব্দ—সবই যেন প্রাণ পায় প্রজাপতির ডানায়। বাতাসে ভেসে বেড়ানো প্রজাপতির চলাফেরা যেন এক অবিরাম নৃত্য, যেখানে সে ছড়িয়ে দেয় প্রাণের সুর, রঙের উচ্ছ্বাস।

ব্যস্ত শহরের যানজট, মানুষের কোলাহল আর ধুলাময় পরিবেশের মধ্যেও প্রজাপতির অবাধ বিচরণ এক প্রশান্তির বার্তা বয়ে আনে প্রকৃতিপ্রেমীদের মনে। পৃথিবীর সবচেয়ে রঙিন পতঙ্গ হিসেবেই ধরা হয় প্রজাপতিকে। আর তাই একে বলা হয় ‘প্রকৃতির অলংকার’। শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্য নয়, এদের জীবনচক্রও যেন এক বিস্ময়ের গল্প।

প্রজাপতির জন্ম হয় ছোট্ট একটি ডিম থেকে, কিন্তু সোজাসুজি নয়। প্রথমে জন্ম নেয় শুঁয়াপোকা, তারপর ধীরে ধীরে গুটিতে পরিণত হয়, যা পিউপা নামে পরিচিত। সেই পিউপা থেকেই একদিন বের হয়ে আসে রঙিন ডানা মেলে ধরা প্রজাপতি। এই চার ধাপের জীবনচক্র পুরোটা মিলিয়ে প্রজাতিভেদে তিন সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত হতে পারে। শুঁয়াপোকারা গাছের পাতা খেয়ে বেড়ে ওঠে, আর পূর্ণাঙ্গ প্রজাপতি খুঁজে ফেরে ফুলের মধু। প্রকৃতির চক্রে তাদের এই পথচলা নানাভাবে পরিবেশের উপকারে আসে।

প্রজাপতির ডানার গঠনও বৈজ্ঞানিকভাবে চমকপ্রদ। একধরনের চিটিন নামক প্রোটিনের স্তর দিয়ে তৈরি এই ডানা হালকা ও স্বচ্ছ। সূর্যের আলো পড়লে এর ওপর প্রতিফলিত হয়ে সৃষ্টি করে নানা রকম রং। সেই কারণেই তো দেখা মেলে হাজারো রঙে রঙিন প্রজাপতির, যেন প্রকৃতির রংতুলি এদের পাখায় এঁকে দিয়েছে স্বপ্ন।

রক্তজবা ফুলে মধু খেতে এসেছে বড় প্রজাপতি। কাটাছড়ি, রাঙামাটি
ছবি: সুপ্রিয় চাকমা

ফুলের পরাগায়ণ, গাছের প্রজনন—এই ছোট্ট প্রাণীগুলো পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় রাখে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। খাদ্য হিসেবে নেয় ফুলের রেণু, গাছের রস, এমনকি পচা ফল ও কিছু খনিজ উপাদান। আর তাদের উড়ান! ঘণ্টায় ৮ থেকে ১৫ কিলোমিটার বেগে উড়ে বেড়ায় তারা। কিছু প্রজাতির গতি আরও বেশি হতে পারে। আয়ু খুব দীর্ঘ নয়—মাত্র ২ থেকে ৪ সপ্তাহ। এই স্বল্প সময়েই জীবনের মূল কাজ দুটি—খাদ্য গ্রহণ আর প্রজনন।

বাংলাদেশে প্রায় ৪০০টি প্রজাতির প্রজাপতির সন্ধান পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে কিছু জনপ্রিয় নাম—উদয়াবল্লী, সাতডোরা (সাতডোরা কৌরী), মনমেঘা, বনবেদে, রাই নকশি, বড় নীলপাখা, সাদা রাজহাঁস, খয়েরি পাখা ইত্যাদি। একেকটা নামেই যেন মিশে আছে ইতিহাস, সাহিত্য, আবেগ ও প্রকৃতির নিঃশব্দ আহ্বান।

তবে দুঃখজনকভাবে আমাদের অসচেতনতা ও পরিবেশবিনাশী কর্মকাণ্ডের কারণে প্রজাপতির আবাস ধ্বংস হচ্ছে দ্রুত। বনভূমি উজাড়, গাছপালা নিধন এবং নির্বিচার বসতি সম্প্রসারণের ফলে এই রঙিন প্রাণীরা হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের দৃষ্টিসীমা থেকে, যার প্রভাব পড়ছে পুরো পরিবেশের ওপর—জলবায়ু পরিবর্তনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে পৃথিবীকে।

সমাধান একটাই—বৃক্ষরোপণ ও প্রকৃতি সংরক্ষণ। যত বেশি গাছ, তত বেশি প্রজাপতির বাসস্থান। গবেষকেরা বলছেন, প্রয়োজন জাতীয়ভাবে প্রজাপতি সংরক্ষণের উদ্যোগ, বনাঞ্চলে প্রজাপতি পার্ক স্থাপন এবং সচেতনতামূলক কার্যক্রম।

সৌন্দর্যের প্রতীক এই পতঙ্গগুলো শুধু দেখার জন্য নয়, প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায়ও গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তাই আসুন, আমরা সবাই মিলে প্রজাপতির জন্য নিরাপদ আশ্রয় তৈরি করি। প্রকৃতিকে ভালোবেসে, প্রজাপতিকে টিকিয়ে রাখাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

শিক্ষার্থী, ঝালকাঠি এন এস কামিল মাদ্রাসা