গানের আড়ালে লুকানো জীবনের গল্প বলে নচিকেতার গান
বাংলা গানের ভুবনে নব্বইয়ের দশকে যে ঝড় উঠেছিল, তার কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন নচিকেতা চক্রবর্তী।
নচিকেতার গান মানেই মানসপটে যত্ন করে রেখে দেওয়ার মতো এক ছোট্ট জীবনের গল্প-কাহিনি। গানের কথা ও সুরের মাধ্যমে তিনি সামাজিক বাস্তবতা, নিরেট সত্য, জনসাধারণ জীবন, প্রেম কিংবা বিরহের গল্প, চরম দুর্ভোগ থেকে শুরু করে তেজস্বী প্রতিবাদ বিস্ময়করভাবে তুলে ধরেছেন।
আগে গান ঘটা করে ধারাবাহিকভাবে শোনা হতো না। এখন আসক্তি বাড়ছে। ধীরে ধীরে গাননির্ভর হয়ে উঠছি। গানে শান্তি খুঁজি, ভরসা পাই, স্বপ্ন দেখি, জীবনের স্বাদ-স্বাচ্ছন্দ্যের সান্নিধ্য খুঁজে পাই। প্রায়ই মনে হয়, সৃষ্টিকর্তার সব সৌন্দর্য, শৈল্পিকতা, আশীর্বাদ দিয়েছেন কেবলই তাঁদের, যাঁদের কণ্ঠে সুরের মিতালি খেলা করে।
গান শোনা হয় কাজ করতে করতে। অফিসের লম্বা সময় কম্পিউটারে রিপোর্ট তৈরি, সাজেশন তৈরিসহ নানা কাজ করতে হয়। ক্লান্তি ও মাথাধরা তো থাকেই। আমার কাছে এর সমাধানের ওষুধ গান। গান শুনতে শুনতে কখন কাজ শেষ হয়ে যায় টেরই পাই না। আমার শোনা গানের তালিকা খুব বেশি লম্বা নয়। এর মধ্যে ‘একদিন স্বপ্নের দিন বেদনার বর্ণবিহীন’ ও ‘সোনালি প্রান্তরে ভ্রমরার গুঞ্জনে’ গান দুটি থাকেই।
গান দুটি ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ সিনেমার। ‘বারে বারে যেন, আসি ফিরে এমন দেশে/ উষ্ণ বালির বুকে, সূর্য যেথায় ওঠে হেসে...’। আহা, কী দারুণ কথা! গানটি নচিকেতার গাওয়া। এত সুন্দর গায়কি! একদিন তাঁর সম্পর্কে জানার আগ্রহ থেকেই ওনার সব গান অনুসন্ধান করি। ওনার প্রায় সব গান ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি, কিন্তু জানতাম না।
বাংলা গানের ভুবনে নব্বইয়ের দশকে যে ঝড় উঠেছিল, তার কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন নচিকেতা চক্রবর্তী। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত প্রথম অ্যালবাম ‘এই আমি, এই তুমি’ তাঁকে রাতারাতি তারকাখ্যাতি এনে দেয়। বিশেষ করে ‘নীলাঞ্জনা’ গানটি তরুণ সমাজের প্রেম ও যন্ত্রণা দুটোই একসঙ্গে ফুটিয়ে তোলে।
জীবনের টানাপোড়নের এক বাবার গল্প; যেখানে বাবা বলেন, ‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার/ মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার ওপার’। বলছি ‘বৃদ্ধাশ্রম’ গানটির কথা। এই এক গান পুরো বাঙালির মনকে নাড়া দেয়। হাজারো বাবার চোখে জল ঝরে। হয়তো–বা অনুতপ্ত হয় শত শত ছেলে।
‘তুমি আসবে বলেই আকাশ মেঘলা বৃষ্টি এখনো হয়নি, তুমি আসবে বলেই কৃষ্ণচূড়ার ফুলগুলো ঝরে যায়নি’ গানটি প্রেম, ভালোবাসা ও অপেক্ষার কথা বলে। মানুষ প্রথম প্রেমে পড়লেই যেন গানটি শোনে। প্রেম ও ভালোবাসার আরেক অনন্য সৃষ্টি ‘নীলাঞ্জনা’। আমার তো মনে হয় নীলাঞ্জনা যাদের নাম, হয়তো–বা এ গান থেকেই অনুপ্রাণিত।
‘আসলে তো তোমরাই করেছ শেষ,/ হাসপাতাল না থাকলে জনগণ/ নার্সিং হোমে যাবে অবশেষ…’, ‘ও ডাক্তার’ গানটিতে দুঃসাহসিক সত্য অকপটে গেয়েছেন তিনি। তাঁর প্রতিবাদী গানগুলো মানুষের অধিকার আদায়ে সোচ্চার এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ করে।
নচিকেতার কথার ভঙ্গি সহজবোধ্য, যেন আমাদের চারপাশের সাধারণ মানুষের গল্পই বলছেন। তাঁর গান শহরের কফিশপে যেমন বাজে, তেমনি বাজে গ্রামের চায়ের দোকানেও। গানগুলো একদিকে যেমন কষ্টের কথা বলে, অন্যদিকে জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষাকেও জাগিয়ে তোলে।
আজও নচিকেতার গান নতুন প্রজন্মকে সমানভাবে টানে। তাঁর কণ্ঠ, তাঁর কথা, তাঁর সুর—সবই একসঙ্গে মিলে জীবনের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে। হয়তো এ কারণেই ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে, ক্লান্ত মুহূর্তে কিংবা একাকী সন্ধ্যায়, নচিকেতার গান নতুন করে বাঁচার এবং অনুপ্রেরণার অদৃশ্য শক্তি জোগায়।
বন্ধু, ভৈরব বন্ধুসভা