তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। সারাক্ষণ গলায় ঝুলে ঝুলে আব্বুর আদর খাই। আব্বু তখন কালীগঞ্জ উপজেলা শিক্ষা অফিসার। পেয়ারাগাছে ঝুলি। একদৌড়ে অফিসের পেছনে জানালা দিয়ে ‘কখন ছুটি হবে বাবা, পূজা দেখতে যাব কিন্তু!’ তিনি বলতেন, ‘অফিসে অনেক কাজ, মা। কাজ শেষ না করে বাড়িতে ফিরব কী করে?’ টলমল চোখে তাকিয়ে থাকি। আমার আর তর সয় না। বাড়িতে ফিরে মন খারাপ করে বসে থাকি। পিংকি খেলতে এলে ভেংচি কেটে দিই।
বাড়ির খুব কাছেই শীতলক্ষ্যা নদী। স্টিমার চলে গেলে একদৌড়ে পানির দোলদোলানি দেখি। পা ভেজাই। কাগজের নৌকা ভাসিয়ে তাকিয়ে থাকি। আবার দৌড়! আবার অফিসে হামলা। বকুনি খেয়ে ভ্যা... করে কান্না। অফিসে নেহার কাকা হাতে কয়েকটা চকলেট দিয়ে বলেন, সন্ধ্যায় পূজা দেখতে যেতে পারব আব্বুর সঙ্গে। দাওয়াতটা আসলে নেহার কাকার বাড়িতেই।
চোখ মেলে দেখি, আব্বু পেছনে দাঁড়িয়ে। টলমল চোখে তাঁকে বলছি, ‘আমি বেলাদি হব না তো?’ ‘না, কখনোই নয়।’ আব্বু দৃঢ় কণ্ঠে বললেন।
ঝিলমিল সন্ধ্যায় লাল ফ্রক আর মাথায় ঝুটি বেঁধে হোন্ডার পেছনে আব্বুকে জাপটে ধরে বসে থাকি। পাখিদের সুরেলা ডাকের মুগ্ধতা ছড়ানো সন্ধ্যা, ঘনপাড়ার ঢাকঢোল, বাদ্যবাজনা, উলুধ্বনি আর মুখর মানুষের হাস্যরস, ধূপের ঘ্রাণ, আনন্দ আর প্রার্থনা একাকার হয়ে গেছে। ওই দিকে হাঁড়িভর্তি বড় বড় রসগোল্লা, নানা রকম মন্ডামিঠাই, বিশাল কড়াইতে সদ্য ভাজা লুচি, দই–চিড়া, ফলফলাদির বাহারি আমেজে ম ম ঘ্রাণ। মন টানে রসগোল্লার দিকে। এর চেয়ে মজার খাবার আর কী হতে পারে! জন্মেছি যেন এর জন্যই। খুব মজা করে রসগোল্লা খাব বলেই না পূজায় এসেছি! এখনো ‘ভগবতী মিষ্টান্ন ভান্ডার’–এর জন্য মন কেমন করে!
উৎসবমুখর বাড়ি। আনন্দ উপচে পড়ছে। সারি বেঁধে খেতে বসেছে সবাই। টেবিলভর্তি নানা রকম খাবার। শেষ পাতে মজার রসগোল্লা। এরই ফাঁকে নেহার কাকা তাঁর মেয়ে বেলাদিকে নিয়ে এলেন। যেন পুতুল বউ! অবয়বজুড়ে খেলা করছে স্নেহমাখা আদরের রোশনাই। আমার ভাবনাটুকু এমন, একদৌড়ে বেলাদিকে নিয়ে কদমতলায় খেলতে চলে যাই! বেলাদি খেলবে, পড়বে, বড় হবে, তারপর অফিসে যাবে কাজ করতে, তারপর বিয়ে। ছোট্ট মনে কত ভাবনা খেলা করে! বেলাদিকে নিয়ে পূজামণ্ডপ দেখতে গেলে আনন্দ, গান, হইহুল্লোড়, রং আর বাহারি নাচের আয়োজনেও একটা বিষাদ আমাকে গ্রাস করে। দেখি, বেলাদি হু হু করে কাঁদছে। কান্নাটুকু কেবলই আমার বুকে বেদনা হয়ে বিঁধছে। পূজার অনুষ্ঠান উপভোগ করে এবার তবে বাড়িতে ফেরার পালা। বাক্সভরে কাকিমা হরেক রকম নাড়ু আর সন্দেশ দিয়ে দিলেন। তখনো আমার চোখভরা জল।
শীতলক্ষ্যার কোল ঘেঁষে অবাক তারার সন্ধ্যা। পাখিদের ওড়াউড়ি মিছিল। মিষ্টি বাতাসে আদর আদর গুনগুনানি। আব্বুকে বললাম, ‘বেলাদি দুর্গাদেবীকে দেখে কাঁদল কেন?’
‘বেলার বিয়ে হয়ে গেছে। ও আর স্কুলে যাবে না। বন্ধুদের সঙ্গে খেলবে না।’ আব্বু ক্ষীণকণ্ঠে বলতে লাগলেন।
‘তাহলে বেলাদি কী করবে?’ আব্বু চুপ করে রইলেন। ‘আচ্ছা আব্বু, নেহার কাকা কি খারাপ মানুষ? আর বাবা হলেই কি অন্যায় করা যায়?’ আব্বু আর কিছু বললেন না।
গুটিসুটি হয়ে ঘুম ঘুম চোখে পূজার গন্ধ, আরতি, আলোর ঝলকানি মনকে জানান দিচ্ছে, আচ্ছা! জীবন এত সুন্দর কেন? আনন্দই জীবন, ঠিক দুর্গার মতোন। আমি কি দুর্গার মতো এত সুন্দর হতে পারব? বেলাদিও তো দুর্গা হতে চেয়েছিল। পড়াশোনা না করলে তো জীবন আঁধারে ঢেকে যায়। আনন্দগুলো দূর থেকে কেবলই হাসে। কাছে ভেড়ে না।
নতুন ভোর। দখিনা বারান্দায় আলোর নাচন। বাগান থেকে ভেসে আসছে ফুলের মিষ্টি গন্ধ। চোখ মেলে দেখি, আব্বু পেছনে দাঁড়িয়ে। টলমল চোখে তাঁকে বলছি, ‘আমি বেলাদি হব না তো?’ ‘না, কখনোই নয়।’ আব্বু দৃঢ় কণ্ঠে বললেন।
অতঃপর আব্বুর গলায় ঝুলে ঝুলে আবারও আনন্দ, হাসি আর রাশি রাশি গান। পাশেই স্নিগ্ধ আমেজে ফুটতে শুরু করেছে অজস্র মৌ ফুল।
বেঁচে থাকার জন্য একটু আদর, দখিনা দুয়ারে মিঠে সোনারোদ, শীতলপাটিতে জোছনার মাখামাখি, কলাপাতায় ফেনাভাত আর সোনার পালঙ্কে গল্পকথার অথই নদীই যথেষ্ট নয় কি?
ঢাকা, বাংলাদেশ