মশাবাহিত রোগ: আপনি কতটা সচেতন

মানুষকে মশাবাহিত রোগ থেকে সচেতন করার লক্ষ্যে প্রতিবছর ২০ আগস্ট ‘বিশ্ব মশা দিবস’ পালিত হয়ছবি: সাইফুল ইসলাম

যুগের পর যুগ মানুষের রক্ত খেয়ে খ্যাতি অর্জন করেছে মশা। বিশ্ব জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি সৃষ্টি করেছে। ছড়িয়েছে বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক রোগ। সারা রাত মানুষের কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করে ঘুম নষ্ট করে, আর মানুষের রক্ত খেয়ে স্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে পতঙ্গটি খ্যাতি লাভ করেছে নিজের নামে একটি দিবস পেয়ে।

মানুষকে মশাবাহিত রোগ থেকে সচেতন করার লক্ষ্যে প্রতিবছর ২০ আগস্ট ‘বিশ্ব মশা দিবস’ পালিত হয়। এটি পালিত হয় ব্রিটিশ চিকিৎসক স্যার রোনাল্ড রসের আবিষ্কারকে স্মরণ করতে, যিনি ১৮৯৭ সালের ২০ আগস্ট প্রমাণ করেন যে ম্যালেরিয়া রোগ অ্যানোফিলিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। পরবর্তী সময়ে ১৯০২ সালে তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।‎

‎বিভিন্ন প্রজাতির মশা ও মশাবাহিত রোগ
বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর মশাবাহিত রোগে প্রায় এক মিলিয়নের বেশি মানুষ মারা যায় এবং প্রায় ৭০০ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয়। প্রধান তিন ধরনের মশার মাধ্যমে রোগ ছড়ায়:
• এডিস মশা—ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, লিম্ফ্যাটিক ফাইলেরিয়াসিস, হলুদ জ্বর ও জিকা ভাইরাস।
• অ্যানোফিলিস মশা—ম্যালেরিয়া ও লিম্ফ্যাটিক ফাইলেরিয়াসিস।
• কিউলেক্স মশা—জাপানি এনসেফালাইটিস, লিম্ফ্যাটিক ফাইলেরিয়াসিস ও ওয়েস্ট নাইল ফিভার।

মশাবাহিত প্রধান রোগসমূহ
‎১. ডেঙ্গু—
• শনাক্ত: ১৯৪৩ সালে প্রথম শনাক্ত করেন রেন কিমুরা ও সুনুমা হোট্টা। পরে ১৯৪৪ সালে ডক্টর আলবার্ট সাবিন ও ওয়াল্টার শ্লেসিঞ্জার স্বাধীনভাবে ডেঙ্গু ও সান্ডফ্লাইর ওপর গবেষণা করে ডেঙ্গু ভাইরাস শনাক্ত করেন। অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, মহামারি আকারে ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ডে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ১৯৫০ সালে। ১৯৬২ সালে বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয়।
• ‎লক্ষণ: জ্বর, মাথাব্যথা, শরীরে লালচে দানা, শরীর ব্যথা, হাড় ও চোখের ব্যথা, বমি ভাব ও পাতলা পায়খানা ইত্যাদি।

বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর মশাবাহিত রোগে প্রায় এক মিলিয়নের বেশি মানুষ মারা যায় এবং প্রায় ৭০০ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয়
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

২. চিকুনগুনিয়া—
• শনাক্ত: ১৯৫২ সালে প্রথমবার তানজানিয়ার মাকোন্দে অঞ্চলে চিকুনগুনিয়া ভাইরাস শনাক্ত হয়। ‘চিকুনগুনিয়া’ শব্দটি এসেছে মাকোন্দে ভাষা থেকে, যার অর্থ ‘মোচড়ানো শরীর’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, আফ্রিকা থেকে এই ভাইরাস পরবর্তী সময়ে এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। ২০০৫ থেকে ২০০৬ সালের দিকে ভারতের কেরালা ও কর্ণাটক রাজ্যে ব্যাপক হারে চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ২০০৮ সালে বাংলাদেশে প্রথম চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়। সবচেয়ে বড় প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় ২০১৭ সালে, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার মানুষ আক্রান্ত হয়।
• ‎লক্ষণ: হঠাৎ জ্বর, তীব্র ঘাড়ব্যথা, মাথাব্যথা, চোখে ও পেশিতে ব্যথা, বমি ভাব, ত্বকে লালচে দানা, চুলকানি, ক্লান্তিভাব, চোখ লাল হওয়া ইত্যাদি।

৩. ম্যালেরিয়া—
• শনাক্ত: প্রাচীন গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটিস (৪৬০-৩৭০ খ্রিষ্টপূর্ব) ম্যালেরিয়ার লক্ষণ বর্ণনা করেছেন। আধুনিক বিজ্ঞান অনুযায়ী, ১৮৮০ সালে ফরাসি চিকিৎসাবিদ চার্লস ল্যাভেরান প্রথম ম্যালেরিয়ার জীবাণু প্লাজমোডিয়াম পরজীবী আবিষ্কার করেন। এই আবিষ্কারের জন্য তিনি ১৯০৭ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ‎১৮৯৭ সালে ব্রিটিশ চিকিৎসক স্যার রোনাল্ড রস প্রমাণ করেন যে অ্যানোফিলিস মশার মাধ্যমে ম্যালেরিয়া মানুষের শরীরে রোগ ছড়ায়।
• ‎লক্ষণ: জ্বর ১০৪ ডিগ্রি থেকে ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত ওঠানামা করতে পারে। এ ছাড়া কাঁপুনি, অতিরিক্ত ঘাম, বমি ভাব।

আরও পড়ুন

৪. ফাইলেরিয়া—
• শনাক্ত: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ফাইলেরিয়ার পুরো নাম লিম্ফ্যটিক ফাইলেরিয়াসিস, যা একটি গোদ রোগ বা পরজীবীজনিত দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণ। প্রথমবার ১৮৭৭ সালে এই রোগ ও জীবাণু শনাক্ত করেন স্কটিশ ডাক্তার প্যাট্রিক ম্যানসন। এই পরজীবী মানুষের দেহে ছড়ায় কিওলেক্স, অ্যানোফিলিস ও ম্যানসোনিয়া প্রজাতির মশার মাধ্যমে। বিশ্বে একমাত্র ফাইলেরিয়া রোগের হাসপাতাল বাংলাদেশের নীলফামারীর সৈয়দপুরে অবস্থিত।
• লক্ষণ: হাত, পাঁ, স্তন বা পুরুষের অণ্ডকোষ অস্বাভাবিকভাবে ফুলে যাওয়া, লসিকা গ্রন্থির প্রদাহ, উচ্চ জ্বর, আক্রান্ত স্থানে তীব্র ব্যথা, ঘা হওয়া, ত্বক পুরু হয়ে যাওয়া ও রং পরিবর্তন।‎

‎মশাবাহিত রোগ হলে করণীয়
‎সর্বপ্রথম দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এরপর স্বাভাবিক খাবারের পাশাপাশি তরলজাতীয় খাবার যেমন স্যালাইন, ডাবের পানি, লেবুর শরবত, ফলের রস ও স্যুপ খেতে হবে। এ ছাড়া ঘুমানোর সময় বিছানায় মশারি টেনে ঘুমাতে হবে আর রোগের লক্ষণ দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শে উন্নত চিকিৎসা গ্রহণ এবং প্রয়োজনীয় টিকা নিতে হবে।

কুতুবদিয়া দ্বীপ, কক্সবাজার