আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে, ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই, সকাল হতেই সারা বাংলাদেশে থমথমে এক নীরবতা। আন্দোলন, মিছিল আর পুলিশের গুলিতে মানুষ নিহত হওয়ার খবর তখন দেশজুড়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। তখনই হঠাৎ দেশে সব ধরনের ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়। মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই, ব্রডব্যান্ডও নেই। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব—সব অচল। কেউ কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না, সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে পারছে না। মানুষ শুধু টের পায়, কোনো বড় কিছু ঘটে যাচ্ছে।
জুলাই অভ্যুত্থানের সেই দিনে ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাওয়া অনেককেই ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। মনে করিয়ে দিয়েছিল, ইন্টারনেট আমাদের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি, এই ইন্টারনেট কীভাবে এল? কাঁরা প্রথম ভেবেছিল, এক দেশের মানুষ আরেক দেশের মানুষের সঙ্গে মুহূর্তেই কথা বলতে পারবে, খবর পাঠাবে, ছবি দেখাবে? কীভাবে তৈরি হলো এই অদৃশ্য যোগাযোগের জাল? আজ জানব ইন্টারনেটের জন্মকথা।
যুদ্ধ থেকে যোগাযোগের জগতে
ইন্টারনেটের জন্ম হঠাৎ হয়নি। এর পেছনে রয়েছে যুদ্ধের ভয়, বিজ্ঞানের জটিল গবেষণা এবং মানুষের অদম্য জ্ঞান অর্জনের আগ্রহ। সময়টা ছিল ১৯৫০ থেকে ১৯৬০-এর দশক। বিশ্ব ছিল ঠান্ডা যুদ্ধের উত্তেজনায়। সে সময় আমেরিকার বিজ্ঞানীরা ভাবছিলেন, যদি কখনো পারমাণবিক হামলা হয়, তাহলে গুরুত্বপূর্ণ কম্পিউটার ও তথ্য কীভাবে নিরাপদে রাখা যাবে? অনেক চিন্তা করার পর তাঁরা বুঝতে পারলেন, একটি কম্পিউটারের সঙ্গে অন্য কম্পিউটারের যোগাযোগ থাকলে হয়তো হামলার মধ্যেও তথ্য রক্ষা করা যাবে।
তখন ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) এক বিজ্ঞানী জোসেফ কার্ল রবনেট লিকলিডার কল্পনা করলেন, যদি বিশ্বের সব কম্পিউটার একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে, তবে তথ্য বিনিময় সহজ হবে। তাঁর ধারণা ছিল, মানুষ তাঁর ডেস্ক থেকে বিশ্বের অন্য প্রান্তের কম্পিউটারেও কাজের জন্য সংযোগ করতে পারবে।
প্যাকেট সুইচিং: বিপ্লবের মূল চাবিকাঠি
এবার কল্পনার পালা শেষ করে বাস্তবে তথ্য আদান-প্রদানের পালা শুরু হলো। কিন্তু তখন তথ্য আদান-প্রদানে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল ফোন লাইনের মতো ধীরগতির সংযোগ। তখনকার সংযোগগুলো টেলিফোন লাইনের মাধ্যমে চলত, তাই ডেটা পাঠাতে অনেক সময় লাগত। এই সমস্যার সমাধান খুঁজতে একদল বিজ্ঞানী ভাবলেন, বড় তথ্য একসঙ্গে না পাঠিয়ে যদি ছোট ছোট প্যাকেটে ভাগ করে পাঠানো যায়, তাহলে তা দ্রুত ও সহজে গন্তব্যে পৌঁছাবে। এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘প্যাকেট সুইচিং’। পল বারান ও ডোনাল্ড ডেভিস এ ধারণার ভিত্তি তৈরি করেন। ফলে একসঙ্গে অনেক ব্যবহারকারী সহজে এবং কম খরচে তথ্য আদান-প্রদান করতে শুরু করে।
আর্পানেট: ইন্টারনেটের প্রথম রূপ
ছোট ছোট প্যাকেটে করে তথ্য পাঠানোর পদ্ধতি আবিষ্কারের পর এবার সেটিকে কাজে লাগানোর সময় এল। তখনকার দিনে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শক্তিধর দেশ আমেরিকা তাদের গবেষণা সংস্থাগুলোর মধ্যে তথ্য ভাগাভাগির জন্য এমন একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করতে চাইল, যেখানে দূরের বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাগুলোর কম্পিউটার একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারবে। এ জন্য তারা তৈরি করল ‘আর্পানেট’। নামটি এসেছে আর্সাপ্রযুক্ত গবেষণা প্রকল্প সংস্থা নেটওয়ার্ক থেকে, সংক্ষেপে ‘আর্পা’ (যা পরে ‘ডার্পা’ নামে পরিচিত হয়)।
১৯৬৯ সালের ২৯ অক্টোবর, রাত তখন ঠিক ১০টা ৩০ মিনিট। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া থেকে স্ট্যানফোর্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটে একটি মেসেজ পাঠানোর চেষ্টা চলছিল। তাদের মেসেজ ছিল খুব ছোট। মেসেজের মাধ্যমে ‘LOGIN’ শব্দটি পাঠানোর কথা। কিন্তু প্রথমেই মজার এক ঘটনা ঘটল। মেসেজ পাঠানোর সময়ই কম্পিউটার হঠাৎ ক্র্যাশ করল। ফলে পুরো ‘LOGIN’ শব্দটি যাওয়ার আগে শুধু ‘LO’ পর্যন্ত গিয়েছিল। সেই ‘LO’ দিয়েই তৈরি হলো ইতিহাস। এটাই ছিল মানুষের পাঠানো পৃথিবীর প্রথম ইন্টারনেট মেসেজ, যা পরে ইন্টারনেটের বিস্ময়কর জগতে প্রবেশের দরজা খুলে দেয়।
টিসিপি/আইপি: ইন্টারনেটের চালিকা শক্তি
আর্পানেট সফল হওয়ার পর প্রয়োজন হলো এমন এক নিয়মের, যাতে বিশ্বের যেকোনো কম্পিউটার একে অপরের সঙ্গে সহজে যুক্ত হতে পারে। তখন ভিন্টন সার্ফ ও বব কান ১৯৭০-এর দশকে তৈরি করলেন টিসিপি/আইপি প্রটোকল (তথ্য প্রেরণ ও গ্রহণের নিয়ম), যা ইন্টারনেটের জন্য এক বড় আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়ায়।
এই নিয়মের মাধ্যমে ঠিক করা হলো, কীভাবে তথ্যকে ছোট ছোট প্যাকেটে ভাগ করে পাঠানো হবে এবং কীভাবে সেই প্যাকেটগুলো ঠিক ঠিক গন্তব্যে পৌঁছে আবার একত্র হবে। ফলে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে থাকা কম্পিউটারগুলোর মধ্যে যোগাযোগ সহজ হয়ে গেল। অবশেষে ১৯৮৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে আর্পানেট আনুষ্ঠানিকভাবে টিসিপি/আইপি ব্যবহার শুরু করে। এদিনকে ইন্টারনেটের জন্মদিনও বলা হয়। কারণ, এভাবেই ইন্টারনেট তার সত্যিকারের রূপ পায়।
নাম ‘ইন্টারনেট’ হলো কীভাবে
টিসিপি/আইপি ব্যবহার শুরু হওয়ার পর বিশ্বের বিভিন্ন নেটওয়ার্ক একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে। তখন এক নেটওয়ার্কের সঙ্গে আরেক নেটওয়ার্ক মিলে তৈরি হয় নেটওয়ার্কের নেটওয়ার্ক। এ ধারণা থেকে এটিকে বলা হতো ‘ইন্টারনেটওয়ার্ক’। তখন এত বড় শব্দের পরিবর্তে সবাই সংক্ষেপে বলতে শুরু করে ‘ইন্টারনেট’। এভাবেই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় যোগাযোগের মাধ্যমের নাম হয়ে যায় ইন্টারনেট।
ইন্টারনেট হয়ে ওঠে বিশ্বব্যাপী
১৯৯০ সালে টিম বার্নার্স-লি নামের এক বিজ্ঞানী ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (ডব্লিউডব্লিউডব্লিউ), এইচটিএমএল, এইচটিটিপি এবং প্রথম ওয়েব ব্রাউজার তৈরি করেন। ইন্টারনেট ছিল আগে থেকেই। তিনি এটি সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য সহজ করে তোলেন। ফলে আমরা ইন্টারনেটে ঘুরে বেড়াতে পারি, তথ্য খুঁজে পেতে পারি, ছবি, ভিডিও দেখতে পারি এবং আরও নানা কাজ করতে পারি—সবই খুব সহজে, এক ক্লিকেই। এর পর থেকেই ইন্টারনেট দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। বর্তমানে ব্যবসা, শিক্ষা, বিনোদন, যোগাযোগসহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইন্টারনেট হয়ে উঠেছে অবিচ্ছেদ্য অংশ।
সূত্র: ইন্টারনেট হল অফ ফেম, কম্পিউটার হিস্টরি মিউজিয়াম, ইউসিএলএ নিউজরুম, ইন্টারনেট সোসাইটি, ব্রিটানিকা বিশ্বকোষ, সার্ন (CERN), ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব ফাউন্ডেশন ও উইকিপিডিয়া (বাংলা ও ইংরেজি)।
সহসভাপতি, রাজশাহী বন্ধুসভা