প্রধান পাইলট ক্যাপ্টেন সুমিত সাবহারওয়াল রেডিও কন্ট্রোল টাওয়ারে একটি সংকেত পাঠান। তিনি বলেন, ‘মে ডে! মে ডে! মে ডে!’
ভারতের আহমেদাবাদ শহরে ঘটে যাওয়া বিমান দুর্ঘটনা গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে। ১২ জুন ২০২৫, এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট AI-171, একটি বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার, ভারতের মাটি থেকে ইংল্যান্ডের উদ্দেশে উড্ডয়ন করেছিল। আকাশে ওঠার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বিমানটি ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়ে এবং একটি আবাসিক এলাকার ওপর ভেঙে পড়ে। দুর্ঘটনায় ২৪২ জন যাত্রীর মধ্যে মাত্র একজন প্রাণে বেঁচে ফিরেছেন।
বিমানটি উড্ডয়নের ঠিক পরপরই, যখন মাত্র ৬২৫ ফুট উচ্চতায়, তখনই প্রধান পাইলট ক্যাপ্টেন সুমিত সাবহারওয়াল রেডিও কন্ট্রোল টাওয়ারে একটি সংকেত পাঠান। তিনি বলেন, ‘মে ডে! মে ডে! মে ডে!’ এরপরই কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে বিমানটির সব সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
‘মে ডে’ শব্দটির উচ্চারণ ছিল একটি বিমানচালকের মুখে মৃত্যুর ছায়াতলে দাঁড়িয়ে পাঠানো শেষ বার্তা। এটি চূড়ান্ত বিপদের সংকেত। তবে সাধারণ মানুষ বা অনেক পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এই ‘মে ডে’ শব্দটি আসলে কী? কেন এটি তিনবার বলা হয়? কোথা থেকে হয়েছে এর উৎপত্তি? কেনই–বা এই শব্দের ব্যবহার করা হয় শুধু বিপদের সময়ে?
শব্দটি কোথা থেকে এসেছে
‘মে ডে’ শব্দটি ফরাসি শব্দ “m’aider” থেকে এসেছে, যার অর্থ আমাকে সাহায্য করো। ফরাসি বাক্য “venez m’aider” মানে ‘এসো আমাকে সাহায্য করো’। ১৯২০-এর দশকে যখন বেতার যোগাযোগের মাধ্যমে বিমান যোগাযোগ শুরু হয়, তখন পাইলট ও রেডিও অপারেটরদের জন্য একটি সাধারণ, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সংকেতের প্রয়োজন দেখা দেয়, যা ঝুঁকির মুহূর্তে দ্রুত ও স্পষ্ট বোঝানো যাবে। ইংরেজি হেল্প বা ইমার্জেন্সি শব্দগুলো তখনকার যোগাযোগব্যবস্থায় কার্যকর ছিল না। কারণ, বেতার তরঙ্গে শব্দবিভ্রাট ঘটত।
সমস্যার সমাধানে লন্ডনের ক্রয়ডন বিমানবন্দরের রেডিও অফিসার ফ্রেডেরিক স্ট্যানলি মকফোর্ড “m’aider” শব্দটির ইংরেজীকরণ করেন এবং ‘মে ডে’ শব্দটি প্রস্তাব করেন। এটি ১৯২৩ সাল থেকে ব্যবহার শুরু হয় এবং ১৯২৭ সালে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায়।
শব্দটি কীভাবে এসেছে
‘মে ডে’ শব্দটি একেবারে উদ্দেশ্যমূলকভাবে তৈরি হয়েছে, যা উচ্চারণে সহজ এবং ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে ভুল–বোঝাবুঝি হওয়ার সম্ভাবনা কম। ১৯২০-এর দশকে বেতার যোগাযোগ অত্যন্ত নবীন এবং জটিল ছিল। আন্তর্জাতিক বিমান যোগাযোগের দ্রুত প্রসার ঘটার কারণে একটি নির্দিষ্ট সংকেত প্রয়োজন ছিল, যা বোঝাতে পারবে ‘জরুরি বিপদ’। ইংরেজি ও ফরাসি ভাষার সমন্বয়ে ‘মে ডে’ শব্দটি উদ্ভাবিত হয়। এটি দ্রুত বিমানচালক ও অপারেটরদের মধ্যে প্রচলিত হয়।
কেন এসেছে
মে ডে শব্দটি শুধু প্রাণহানির সংকেত। এটি শোনার পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং উদ্ধারকারীরা ত্বরিতগতিতে কাজ শুরু করেন। সাধারণ জরুরি পরিস্থিতি বা সাহায্যের জন্য অন্য সংকেত যেমন ‘প্যান-প্যান’ ব্যবহৃত হয়, যা প্রাণ-সংকট ছাড়া জরুরি অবস্থা বোঝায়।
মে ডে শব্দটি ব্যবহার করে কোনো পাইলট বা জাহাজের ক্রু জানিয়ে দেন যে তাঁদের জীবন বিপন্ন এবং অবিলম্বে উদ্ধারকাজ শুরু করতে হবে। তাই এটি বিশ্বের বিমান ও সমুদ্র যোগাযোগে সবচেয়ে উচ্চমাত্রার সতর্কতা সংকেত।
কীভাবে ও কখন ব্যবহার করা হয়
শব্দটি সংকেত উচ্চারণের নিয়ম মেনে ব্যবহার করতে হয়। যখন কোনো যান, যেমন বিমান বা জাহাজ, জীবনহানির সংকটে পড়ে, তখন রেডিওতে ‘মে ডে’ শব্দটি তিনবার স্পষ্ট উচ্চারণ করা হয়। এরপর নিজস্ব নাম বা শনাক্তকারী নম্বর, অবস্থান, সমস্যার ধরন ও সাহায্যের প্রয়োজনীয়তা জানান। উদাহরণস্বরূপ ‘মে ডে! মে ডে! মে ডে! দিস ইজ ফ্লাইট এআই২৩৭, ইঞ্জিন ফেইলার, উচ্চতা ৬০০ ফিট, ইমিডিয়েট অ্যাসিসটেন্স রিক্যুয়ারেড।’
এই সংকেত পাওয়ামাত্রই রেডিও অপারেটর বা কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে অন্য সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং উদ্ধারকারী দল সক্রিয় হয়।
আইনি ব্যবহার ও নিয়মাবলি
‘মে ডে’ সংকেতের ব্যবহার আন্তর্জাতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত। ১৯৪৪ সালে গঠিত আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা (আইসিএও) এবং আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক সংস্থা (আইএমও) এটিকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ‘ডিসট্রেস কল’ হিসেবে ঘোষণা করে। এর অর্থ হলো, বিশ্বের সব বেসামরিক বিমান ও সমুদ্রযানগুলো এই সংকেতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে শোনা ও সাড়া দিতে বাধ্য।
আইসিএওর অ্যানেক্স ১০ ভলিউম II অনুযায়ী, কোনো বিমান যখন ‘মে ডে’ সংকেত পাঠায়, তখন কন্ট্রোল টাওয়ারসহ সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলো অবিলম্বে নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য। একইভাবে আইএমওর জিএমডিএসএস (গ্লোবাল মেরিটাইম ডিসট্রেস অ্যান্ড সেফটি সিস্টেম) অনুসারে, সমুদ্রে ‘মে ডে’ সংকেত পাওয়ার পর নিকটবর্তী জাহাজ, কোস্টগার্ড বা উদ্ধারকারী ইউনিট দ্রুত সহায়তায় এগিয়ে আসতে বাধ্য।
আইনত, মে ডে সংকেতের অপব্যবহার কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। জরুরি অবস্থা ছাড়া যদি কেউ মিথ্যা বা অপ্রয়োজনীয়ভাবে এই সংকেত পাঠায়, তাহলে তাঁকে জরিমানা বা কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অনেক দেশে মিথ্যা সংকেত প্রচারের জন্য আলাদা আইন রয়েছে। এ ধরনের অপব্যবহার জরুরি সেবা ব্যাহত করে এবং অতি জরুরি পরিস্থিতিতে সহায়তার প্রক্রিয়া বিলম্বিত করে, যা অন্য কারও জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।
এ ছাড়া আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী, মে ডে সংকেত যখনই ব্যবহৃত হবে, তখনই সেটিকে ‘ডিসট্রেস কন্ডিশন’ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। অন্য কোনো সংকট বা সমস্যার জন্য পৃথক সংকেত রয়েছে, যেমন ‘প্যান-প্যান’, যা ‘জরুরি অবস্থা, কিন্তু তাৎক্ষণিক ভয়াবহতা নয়’ বোঝায়।
সহসভাপতি, রাজশাহী বন্ধুসভা