বন্ধুসভার গল্পে মিশে থাকা প্রেম ও সমুদ্রের ঢেউ

কক্সবাজারে বন্ধুসভার বন্ধুরা, ২০০৯ছবি: সংগৃহীত

২০০৩ সালের কথা। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে অধ্যয়ন করছি, কবি নজরুল হলের ৩০৯ নম্বর কক্ষে থাকি। কক্ষটির নাম ‘রঙের বাড়ই’, মানে প্রিয় বন্ধু। রুমমেট ছিল মাহির, সুফল ও পলাশ। ক্লাস শেষে পাঠাগারে নিয়মিত প্রথম আলো পত্রিকায় বিচরণ করতাম প্রজাপতির মতো এই পাতা থেকে ওই পাতায়। প্রকৃতির রূপ, রস ও গন্ধ অনুভব করলে যেমন লাগে, ঠিক তেমনি কিছু পাতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তাম। বন্ধুসভা পাতা ছিল রসমালাইয়ের মতো। পাঠাগার থেকে পাতাগুলো নিখোঁজ হতো। হোস্টেলের সহকারীরা বিভিন্ন কক্ষে গিয়ে বেড, কাঁথা–বালিশ ও পড়ার টেবিলের চিপাচাপা থেকে সেগুলো উদ্ধার করত।

ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কুমিল্লা ঈশ্বর পাঠশালা–সংলগ্ন পোস্ট অফিসে নীল খামে বন্ধুসভার সদস্য ফরম পূরণ করে পাঠালাম। নাম ছাপা হলো চট্টগ্রাম বন্ধুসভার তালিকায়, দেখে আনন্দের সুধা পান করলাম।

বন্ধুসভার ভালো কাজের স্মৃতিগুলো হৃদয় আকাশে ভেসে ওঠে জলছবির মতো। বন্যার্ত ও নিষ্পেষিত ব্যক্তিদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ, সুবিধাবঞ্চিতদের নিয়ে ফলাহার উৎসব, চিকিৎসার তহবিল সংগ্রহ, অ্যাসিড ও মাদকবিরোধী আন্দোলন, ফুটবল ও ক্রিকেট ম্যাচ, জিপিএ–৫ সংবর্ধনা, পাঠচক্র, মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনি, কীর্তিমানদের স্মরণসভা, গণিত অলিম্পিয়াড, ভাষা প্রতিযোগ, অরণ্যবিহার, নৌবিহারসহ নানা অনুষ্ঠান।

আরও পড়ুন

মাহির ছিল পটিয়া বন্ধুসভার সদস্য। ২০০৯ সালের ১৯ জুন প্রথম আলোর শপথ অনুষ্ঠান। সকাল সাতটায় পটিয়া বন্ধুসভার সঙ্গে মাহিরসহ বাসে কক্সবাজারের উদ্দেশে যাত্রা করলাম ‘বদলে যাও বদলে দাও’ শপথ অনুষ্ঠানে। বাসে বন্ধুরা আনন্দ আয়োজন করল। আঞ্চলিক ধাঁধার আসরও জমেছে বেশ, ‘লম্বা বেডির বাইট্টা চুল ফোয়া বিয়াইদে গোল গোল’। ধাঁধার উত্তর হলো সুপারি।

বন্ধু মাহির জানাল, কক্সবাজার বন্ধুসভার এপির সঙ্গে মুঠোফোনে পরিচয়। সাত বছর ধরে কেউ কাউকে দেখেনি। এমনকি ছবিও না দেখে খুব কাছের বন্ধু হয়ে গেল। অনেকটা অদৃশ্য বন্ধুত্ব, প্রণয় ও ভালোবাসা। কেউ কাউকে সাহস করে বলতে পারেনি, ‘ভালোবাসি’। ওই সময়ে স্মার্টফোন ছিল না। দুজনের সবিনয় নিবেদন ছিল নীল খামের চিঠি। মাহিরকে দেখলাম খুব অস্থির। পারলে বাসের জানালা দিয়ে পাখির ডানায় চড়ে উড়াল দেবে এপির কাছে। এপিকে পাওয়ার জন্য মাজারে কবুতরও মানত করেছে।

মাহিরকে বললাম, চিন্তা করো না। ভালোবাসার মানুষকে না দেখার মধ্যে সুখ আছে, তৃপ্তি আছে, আনন্দ আছে, পাগলামিও আছে। এসব যদি না থাকত, তাহলে ভালোবাসা কখনো সার্থক হতো না।
মাহির বলল, এপির সঙ্গে কথা হয়েছে। দুজনে মিলে সমুদ্রে ভালোবাসার সাম্পানে হারিয়ে যাব কোনো এক অচেনা দ্বীপে। পৃথিবীর সবচেয়ে দামি বাক্যটি বঙ্গোপসাগরের জলরাশি ও বালুকণাকে সাক্ষী রেখে প্রপোজ করব; যাতে পৃথিবীর কেউ গুনে বলতে না পারে, কী পরিমাণ ভালোবাসি।

চট্টগ্রাম বন্ধুসভার নৌবিহার
ছবি: সংগৃহীত

শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে দীর্ঘ লাইন। পেছনে সমুদ্রের বিশাল গর্জন, শুভ্র ঢেউয়ের জলরাশি যেন আনন্দে মেতেছে। বন্ধুদের স্বাগত জানাতে সমুদ্রের ঢেউ তীরে এসে বালুর রাজ্যে আছড়ে পড়ছে আর পা ছুঁয়ে যাচ্ছে জলরাশি।

এদিকে কক্সবাজারে পৌঁছে মাহির নিখোঁজ। নিখোঁজ হওয়ার রহস্য কেউ জানত না। সেদিন সমুদ্রসৈকতে আনন্দ, গান, আড্ডা ও ভোজনরসদ হলো। গায়ক আসিফ আকবর মঞ্চে গাইছিলেন।

সায়াহ্নে ফেরার পালা। সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে, নীল সমুদ্রের ঢেউয়ের তালে তালে নৃত্য করছে নীলাভ জলরাশি। আকাশ হাতছানি দিয়ে সূর্যকে যেন তার বুকে ডাকছে, বেলা শেষ, চলে এসো প্রিয়তমা। আধো আলোতে ঝিঁঝি পোকারা চুটিয়ে প্রেম করছে।

বন্ধু মাহির ফিরছে না, মুঠোফোন বন্ধ। সবাই চিন্তা করছে মাহিরের জন্য। এরই মধ্যে প্রথম আলো প্রতিনিধি রাজ্জাক ভাই কক্সবাজার থানায় যোগাযোগ করেছেন। এসআই মামুন এসে নোট করল, মাহিরের পরিধানে কী রঙের শর্ট প্যান্ট নাকি আন্ডারওয়্যার ছিল। সঙ্গে কোনো মেয়েবন্ধু ছিল কি না, সবার কাছে জিজ্ঞাসা করতে লাগল।

বাস ছেড়ে দেবে ঠিক সেই মুহূর্তে বন্ধু মাহির সমুদ্রের নীল নির্জন ঝাউবনের পাশে এপির হাত ধরে পালতোলা এক সাম্পান থেকে নেমে আসছে সমুদ্রের তীরে। জোছনার আবছায়া আলোয় অপরূপা দেখাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, এ যেন সমুদ্রের থেকে ওঠা স্বর্গীয় জীবন্ত মূর্তি। বাস না ছাড়া পর্যন্ত এপি দাঁড়িয়ে রইল।

কুড়ি বছর পর একদিন জানলাম, বন্ধু মাহির ও এপি দুজনে ভালোবাসার সাম্পানে বেঁধেছে সুখের সংসার।

উপদেষ্টা, পটিয়া বন্ধুসভা