আম্মুর ফোন, ‘তোর লেখা পত্রিকায় ছাপা হয়েছে!’

প্রথম আলো পত্রিকা অবলম্বনে গ্রাফিকস।

ছোটবেলায় আমাদের বাসায় প্রতিদিন সকালে এক মুরব্বি নিয়ম করে রেখে যেতেন প্রথম আলো। পত্রিকার ভাঁজে তখনো আমার আগ্রহ জন্মেনি, ছুঁয়েও দেখিনি কোনো দিন। রাতে যখন সবাই মিলে আড্ডা দিতে বসতাম, বাবা সব সময় বলতেন, ‘পত্রিকা পড়লে মানুষ জানে, পৃথিবীটা কেমন।’ সেই থেকেই মনে জন্ম নিল, জানার এক নতুন তৃষ্ণা। শুরু হলো পত্রিকা পড়ার অভ্যাস।

আমি তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। খেলার পাতা, পড়াশোনার পাতা, ম্যাগাজিন, ‘স্বপ্ন নিয়ে’—এসব অংশ যেন ছিল আমারই দখলে। প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত ফিচার ও গল্পগুলো যত্ন করে কেটে রাখতাম। ডায়েরির পাতায় লিখতাম নিজের ছোট ছোট গল্প, নিজেরই জীবন থেকে তোলা কিছু ভাবনা। হয়তো সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল লেখার প্রতি প্রেম।

আম্মু খুব ভালো গল্প লিখতেন। তাঁর লেখার ভেতর ছিল জীবনের গন্ধ, ছিল নিঃশব্দ আবেগ। হয়তো সেখান থেকেই শিখেছিলাম, গল্প শুধু কাগজে নয়, জীবনেও লেখা যায়।

পত্রিকায় কারও নাম বড় করে ছাপা দেখলে মনে মনে বলতাম, ‘ইশ্! যদি কোনো দিন আমার নামটাও এমন করে পত্রিকার পাতায় আসত!’ সেই মুহূর্তেই জন্ম নিল এক অদ্ভুত স্বপ্ন, একদিন লিখব আর সেই লেখা মানুষ পড়বে। কিন্তু গ্রামে থাকায় জানতাম না, কীভাবে লেখাগুলো পত্রিকায় পাঠাতে হয়।

জেলার কিছু অনলাইন পত্রিকা ছিল। এক বন্ধুর সাহায্যে তাদের ই–মেইল ঠিকানা সংগ্রহ করলাম। অগণিত রাতে আলো নিভিয়ে নীরবে লিখতাম গল্প। তারপর পাঠাতাম। কেউ কোনো উত্তর দিত না। কোনো পত্রিকা ছাপত না। ভীষণ কষ্ট পেতাম। মনে হতো, হয়তো আমার দ্বারা হবে না। অবশেষে মন শক্ত করে লেখালেখি বাদ দিলাম। মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম।

মনের ভেতর লেখার আকাঙ্ক্ষা জেগে রইল। মাধ্যমিক শেষ করে আবার কলম হাতে নিলাম। শুরু করলাম উপন্যাস লেখা। পাণ্ডুলিপি প্রায় গোছানো শেষ। কিন্তু এবার নতুন প্রশ্ন, বই ছাপাবে কে? প্রকাশনীর সঙ্গে যোগাযোগ করতেই তারা বলল, টাকা লাগবে। অথচ তখন আমার হাতে কেবল স্বপ্ন, টাকা নয়। তাই থেমে গেল সেই পথচলা। বুকের ভেতর রয়ে গেল এক গভীর অপূর্ণতা, একটা লেখাও কোথাও ছাপাতে পারিনি।

আরও পড়ুন

এরই মধ্যে বাড়ি ছাড়ার সময় এল। উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার জন্য শহরে চলে এলাম। সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে তখন কোনো ধারণাই ছিল না। একদিন পত্রিকা পড়তে পড়তে চোখে পড়ল একটি বিজ্ঞপ্তি, ‘আপনি যদি গল্প, ফিচার লিখতে পারেন, এই ঠিকানায় মেইল করুন।’ মনে হলো, এই তো সুযোগ! লেখা পাঠালাম একের পর এক। কিন্তু দিন যায়, কোনো সাড়া নেই।

তারপর একদিন, এক সকাল, যার কথা আজও মনে পড়লে গায়ে কাঁটা দেয়। সকাল ৯টার দিকে আম্মুর ফোন। কণ্ঠে কাঁপুনি, উচ্ছ্বাস, আনন্দে ভরা, ‘তোর লেখা পত্রিকায় ছাপা হয়েছে!’ আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। দৌড়ে পত্রিকার দোকানে গিয়ে দেখি, প্রথম আলোয় আমার নাম। শিরোনাম, ‘অবুঝ দিনের গল্প’। এটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম প্রকাশিত লেখা। সেই সকাল যেন আমার জীবনের নতুন সূর্যোদয়। তার পর থেকে পত্রিকাটিই হয়ে উঠল আমার সাথি, আমার অনুপ্রেরণা।

একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় রচনা ও গল্প প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল। প্রিয় শিক্ষক বেলাল সাঈদ স্যারের উৎসাহে আমি অংশগ্রহণ করি। অবিশ্বাস্যভাবে কলেজ শাখার ‘ক’ গ্রুপে প্রথম স্থান অর্জন করি। সেদিন আমাকে নিয়ে জেলা পর্যায়ের একটি পত্রিকায় ফিচার প্রকাশিত হয়েছিল। কলেজের সবাই অভিনন্দন জানাল। মনে হয়েছিল, আমার ভেতরের ছোট্ট লেখকটা হয়তো সত্যিই জেগে উঠেছে।

তারপর আর থেমে থাকিনি। জাতীয় পত্রিকাগুলোয় নিয়মিত লেখা পাঠাতে লাগলাম, অংশগ্রহণ করতে লাগলাম নানা প্রতিযোগিতায়। ২০২০ সালের ইয়াং রাইটার্স অ্যাওয়ার্ডে অংশ নিয়ে প্রথম স্থান অর্জন করি। পেয়েছিলাম ম্যাথ অলিম্পিয়াড পুরস্কারও। এই অর্জনগুলো নিয়ে আবারও প্রথম আলো পত্রিকায় ছাপা হয় আমার ওপর একটি ফিচার।

এরপর একদিন, ঠিক যেন স্বপ্নের মতো একটি প্রকাশনী আমার পাণ্ডুলিপি পড়ে জানাল, তারা নিজের খরচে বই প্রকাশ করবে। সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, হয়তো সৃষ্টিকর্তা আমার চোখের জলগুলো একে একে শব্দে রূপ দিচ্ছেন। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বইমেলায় আসবে আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রোদের দিনে রাত নামে’।

আর ওই যে সেদিন থেকে প্রথম আলো বন্ধুসভাকে এমনভাবে ভালোবেসে ফেলেছি, আর ছাড়তে পারিনি। হয়তো আমার গল্পটা শুরু হয়েছিল একটি পত্রিকার ভাঁজ থেকে। আজ সেই ভাঁজই হয়ে উঠেছে আমার জীবনের পূর্ণতা।