রাস্তার ধারে বসে বইয়ের আলো ছড়াচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণী
রাস্তায় বই বিক্রি করা, মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করা, তাদের গল্প শোনা—সবই এখন তাঁর জীবনের অংশ।
বইয়ের প্রতি ভালোবাসা ছোটবেলা থেকেই। ইচ্ছা, এই ভালোবাসা যেন সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর একদিন হঠাৎই চোখে পড়ল এক চিত্র—বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খাবারের স্টল, সাজসজ্জা, অতিথি সব আছে, কিন্তু বই নেই। একটি বিশ্ববিদ্যালয়, জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র, অথচ বইয়ের কোনো উপস্থিতি নেই—ব্যাপারটি ব্যথা দিল মেহেরুন্নেছা মীমকে। তখনই তিনি ঠিক করলেন, বই শুধু লাইব্রেরির তাকেই বন্দী থাকবে না, মানুষের হাতের কাছে যাবে, বাতাসে বইয়ের গন্ধ ছড়িয়ে পড়বে, রাস্তার ধুলামাখা পথেও শব্দেরা নতুন জীবন পাবে।
এই ভাবনা থেকেই শুরু করলেন বইয়ের ভ্রাম্যমাণ দোকান। ভালোবাসা থেকে শুরু হওয়া একটি যাত্রা, যা ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে এক সাংস্কৃতিক আন্দোলনে। মেহেরুন্নেছা মীম পড়াশোনা করেন বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে। প্রথমে ইচ্ছা ছিল নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে দোকানটি করার। কিন্তু সেখানে বই নিয়ে বসার মতো পরিবেশ নেই। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডকে বেছে নিলেন বই পড়া আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেওয়ার স্থান হিসেবে। মেহেরুন্নেছা মীম বলেন, ‘প্যারিস রোডকে উপযুক্ত মনে হয়েছে। কারণ, অন্যান্য জায়গায় কোনো সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতরে হবে না। আর বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে বই নিয়ে বসার মতো পরিবেশ নেই।’
উদ্যোগ
২০২৪ সালের ৮ নভেম্বর প্রথমবার প্যারিস রোডের পাশে একটি শীতলপাটি বিছিয়ে বসে পড়েন বই নিয়ে। প্রথম দিন দোকান নিয়ে বসার অনুভূতি ছিল সম্পূর্ণ বিস্ময়কর। এত মানুষ বই দেখতে এল, হাতে নিল, যা তাঁর কাছে ছিল অপ্রত্যাশিত। প্রথম দিনেই ৩৭টি বই বিক্রি হয়, যা তাঁর আত্মবিশ্বাস বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। মেহেরুন্নেছা মীম বলেন, ‘আমি প্রথমে আশাই করিনি যে আমার বইগুলো এত মানুষ পড়বে। এটা সত্যিই আনন্দের মুহূর্ত ছিল।’
এই উদ্যোগের মূল চালিকা শক্তি হলো বইয়ের প্রতি ভালোবাসা। মীমের দর্শন স্পষ্ট। তিনি বলেন, ‘ব্যবসা নয়, বই বিক্রি আমার আনন্দ, আমার ভালোবাসা।’ যদিও সীমিত আকারে এটি একটি অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হওয়ার পথ, তবে এর মূল উদ্দেশ্য হলো নিজের আনন্দ ও ভালোবাসাকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। বই বিক্রি সেই ভালোবাসার একটি মাধ্যমমাত্র।
এক বছর ধরে সাফল্যের সঙ্গে চলছে বইয়ের এই ভ্রাম্যমাণ দোকান। এই দৃশ্য এখন প্যারিস রোড ধরে হাঁটা অনেকের কাছেই পরিচিত। সাধারণত সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার বেলা ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দোকানটি বসে। একাই এটি পরিচালনা করেন মেহেরুন্নেছা মীম। আর একাডেমিক চাপ না থাকলে অন্যান্য দিন সন্ধ্যার পর বসেন। সেখানে বইপ্রেমী মানুষেরা ভিড় করেন, বই উল্টে দেখেন, কেনেন, সময় কাটান বইয়ের পাতায়। দোকানের আশপাশে বসে বিনা মূল্যে বই পড়ারও সুযোগ রয়েছে।
প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে
একজন তরুণী হয়ে রাস্তায় বই বিক্রির শুরুটা সহজ ছিল না। মীমকে সমাজের বহু কটু কথা শুনতে হয়েছে, অনলাইনে বুলিংয়ের শিকার হতে হয়েছে। এসব নেতিবাচকতা তাঁকে দমাতে পারেনি। তাঁর মনে হয়েছে, এই কটু কথাগুলো আসলে মানুষের মানসিকতার সমস্যা, তাঁর কাজের নয়। মেহেরুন্নেছা মীম বলেন, ‘প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে জেন্ডারের কোনো সম্পর্ক নেই। যারা বিরোধিতা করে, তারা ছেলে উদ্যোক্তার ক্ষেত্রেও একই কাজ করত। তাই সমস্যাটা মানুষের মনোভাবের।’
মীমের এই দৃঢ়তা শুধু তাঁকে নিজের স্বপ্নের পথ ধরে চলতে সাহায্য করেনি, বরং অন্য তরুণী উদ্যোক্তাদেরও অনুপ্রাণিত করছে। রাস্তায় বই বিক্রি করা, মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করা, তাদের গল্প শোনা—সবই এখন তাঁর জীবনের অংশ। প্রতিটি চ্যালেঞ্জের মধ্যেই লুকিয়ে আছে নতুন শেখার সুযোগ, নতুন কোনো গল্প। যেখানেই যান, তিনি সবার মধ্যে এই বার্তাই ছড়িয়ে দেন—প্রতিবন্ধকতা আসলেই সমস্যা নয়। সাহস, অধ্যবসায় ও আত্মবিশ্বাসই হলো জয়ী হওয়ার চাবিকাঠি।
পাঠকের জন্য উন্মুক্ত অঙ্গন
মীমের ভ্রাম্যমাণ দোকানের একটি সুন্দর দিক হলো, এখানে বিনা মূল্যে বসে বই পড়ার সুযোগ রয়েছে। এর পেছনে একটি মহৎ ভাবনা কাজ করে। সে চায় সবাই বই পড়ুক। তাঁর বিশ্বাস, দোকানে বসে বই পড়ার সুযোগ দিলে যদি কারও বই পড়ার প্রতি আগ্রহ জন্মায়, তবে সেটা তার জন্য এবং দেশের জন্য একটি ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসবে।
বিক্রির উদ্দেশ্যে না হলেও এই শিক্ষার্থী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিত বইয়ের রিভিউ ও নতুন প্রকাশনার খবর দেন। তাঁর এ কাজ একান্তই বইয়ের প্রতি ভালোবাসা থেকে। পাঠকেরা তাঁর রিভিউ দেখে যখন নতুন বই খুঁজে পান, সেটাই তাঁর কাছে বড় প্রাপ্তি।
আগামীর স্বপ্ন
মেহেরুন্নেছা মীম সবার আগে নিজেকে একজন পাঠক বলতে পছন্দ করেন। বই বিক্রেতা বা তরুণ উদ্যোক্তা থেকেও ‘পাঠক’ সম্বোধনটি তাঁর বেশি ভালো লাগে।
মীমের ভবিষ্যতের স্বপ্ন কেবল রাজশাহী পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়, তাঁর সেই স্বপ্নের পরিধি আরও বিস্তৃত। তাঁর স্বপ্ন, সারা দেশে বই পড়ার আন্দোলন ছড়িয়ে যাবে। মানুষ যেন বইয়ের মধ্যেই আনন্দ খুঁজে পায়। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে তিনি একটি পরিবেশবান্ধব, নান্দনিক স্থায়ী লাইব্রেরি গড়ে তোলার কথা ভাবছেন। যেখানে মানুষ শুধু বই পড়বে না, বইয়ের সঙ্গে মেলবন্ধনও গড়ে উঠবে, যেখানে চারপাশে ছড়িয়ে থাকবে অসংখ্য বই। পাঠক আসবে, বইয়ের পাতায় হারিয়ে যাবে, শব্দের মধ্যে ভাসবে আর আলোচনায় মিলিয়ে দেবে মন। সেখানে সাহিত্য পাঠ হবে, গল্পের গন্ধে ভরা সময় কাটবে। শিশুরা আসবে বইয়ের খোঁজে, নতুন দিগন্তে চোখ মেলবে। বইয়ের আলোয় নিজেদের মন-মননে বিকশিত হবে ভাবনা, কল্পনা ও স্বপ্নের বীজ।