হারানো প্রেম ভুলতে বেরিয়েছিলাম, ফিরে পেলাম নিজেকে

বগুড়ার মহাস্থানগড়েছবি: লেখকের সৌজন্যে

কয়েক বছর আগের কথা। মনটা ভীষণ খারাপ ছিল। সম্পর্ক ভাঙার কষ্টে বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠছিল। তখন মনে হলো, এই কষ্ট যদি মনের ভেতর জমিয়ে রাখি, তবে তা আরও বেড়ে যাবে। হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিলাম, বেরিয়ে পড়তে হবে। টাকা ছিল না, ধার করে ভ্রমণে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম।
একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে শুধু বলেছিলাম, ‘দোস্ত, আমার ব্রেকআপ হইছে। ক‍্যাম্পাসে থাকলে আর ভালো লাগবে না।’
বন্ধু বিন্দুমাত্র দেরি না করে ট্রেনের টিকিট কেটে দিল। বেলা দুইটার বনলতা এক্সপ্রেসে রাজশাহীর উদ্দেশে রওনা হলাম।

ট্রেনের জানালার পাশে বসেছিলাম, পাশের সিটে ছিলেন এক বয়স্ক ভদ্রলোক। শুরুতেই ওনার সঙ্গে আলাপ হলো। ভীষণ আন্তরিক মানুষ। টাঙ্গাইলে পৌঁছানো মাত্র চারপাশের সবুজ প্রকৃতি যেন আমাকে নতুনভাবে স্বাগত জানাল। বুকের ভেতরের কষ্টটা ধীরে ধীরে হালকা হতে লাগল। নাটোরের স্টেশনগুলো, চলনবিলের অপরূপ সৌন্দর্য—এসব চোখে ধরা দিল এক নতুন আলোয়। শিমুল ফুলের মৌসুম ছিল, রেললাইনের ধারে লাল শিমুলগাছে প্রকৃতি সেজে উঠেছিল ছবির মতো।

ভ্রমণটি আমার জন্য ছিল এক মোড় ঘোরানো অভিজ্ঞতা।

রাতের অন্ধকারে অবশেষে পৌঁছালাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এক পরিচিত আপুর হলে রাত কাটালাম। পরদিন সকালে বের হলাম ইতিহাস ছোঁয়ার জন্য। প্রথমেই গেলাম বগুড়ার মহাস্থানগড়। অবিরাম বৃষ্টির ভেতরেও প্রাচীন শহরটির ধ্বংসাবশেষ মনে দাগ কাটল। সেখান থেকে ছুটলাম পাহাড়পুরের উদ্দেশে।

নওগাঁর দীর্ঘ পথ পেরিয়ে জয়পুরহাট হয়ে যাওয়া যায়, মাত্র ১২ কিলোমিটার। জয়পুরহাটের রাস্তায় দুই পাশে গাছগাছালির সারি, ভেজা মাটির ঘ্রাণ আর বৃষ্টির ছোঁয়া—সবকিছু এক স্বপ্নময় পরিবেশ তৈরি করেছিল। কিন্তু বিকেল পাঁচটার পর পাহাড়পুরে পৌঁছে দেখি, গেট বন্ধ। দারোয়ানেরা কিছুতেই ঢুকতে দেবেন না। তখন এক কর্মকর্তা এগিয়ে এলেন। কাকতালীয়ভাবে ওনার বাড়িও আমার এলাকায়, নরসিংদীতে। কথাবার্তার ফাঁকে উনি আমাদের ভেতরে ঢুকতে দিলেন। অল্প কিছুক্ষণেই চোখে ভেসে উঠল সবুজে মোড়া পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের মহিমা।

আরও পড়ুন

ফেরার পথে আবার নতুন বিপদ। অটোচালক ইফতার করতে বাড়ি চলে যেতে চাইল; রাত বাড়ছে, অন্য কোনো বাহন নেই। অবশেষে স্থানীয় কিছু লোক বললে সে রাজি হলো আমাদের জয়পুরহাটে ফিরিয়ে নিতে। কিন্তু সেদিন উত্তরবঙ্গের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখি রাজশাহীর কোনো বাস নেই, আছে শুধু বগুড়াগামী বাস। টিকিট কেটে উঠে পড়লাম। কিন্তু এক ঘণ্টা পরও বাস ছাড়ল না। কাউন্টারের লোকজন জানাল, এত রাতে বগুড়ায় গিয়ে ঝুঁকি নেওয়া ভালো হবে না; বরং রাত ১১টায় পঞ্চগড় থেকে আসা ট্রেনে নাটোরে গিয়ে সেখান থেকে বাস ধরতে বলল।

আমরা আবার স্টেশনে ফিরে এলাম। রাত তখন আটটা। ক্লান্ত শরীর নিয়ে মসজিদের নারীদের নামাজের জায়গায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে দিল না। বাইরে বেরিয়ে আসতে হলো। ট্রেন দেরি করে দিবাগত রাত ১২টায় এল। নাটোরে নেমে চারপাশে ঘোর অন্ধকার, অচেনা শহর আর ভয়ভরা এক পরিবেশ। অবশেষে দিবাগত রাত দুইটার দিকে এক বাসে রাজশাহীতে পৌঁছালাম।

পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারে।

এবার নতুন সমস্যার মুখোমুখি—রাতবিরেতে মেয়েদের হলে প্রবেশাধিকার নেই। তাই আমরা এক হোটেলে গিয়ে খাবার খেলাম। তারপর শীতের রাতে প্যারিস রোডের বেঞ্চে বসে কাটালাম দীর্ঘ সময়। মশার যন্ত্রণা, শীতের কষ্ট ও নিঃসঙ্গতা—সব মিলিয়ে সেই রাত আমার জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘতম রাত হয়ে দাঁড়াল।

ভোর হয়ে এলে যখন রাবির হলের দরজা খুলল, তখন ব্যাগ গুছিয়ে স্টেশনের পথে রওনা দিলাম। আমার পরিচিতরা বারবার বলল, ‘আরও কয়েক দিন থেকে যাও।’ কিন্তু হাতে টাকা ছিল না। তাই সকাল সাতটার ট্রেনে ঢাকা ফিরে এলাম।

সেই ভ্রমণ আমার জন্য ছিল এক মোড় ঘোরানো অভিজ্ঞতা। প্রেম ভাঙার কষ্ট ভুলতে বেরিয়েছিলাম, কিন্তু পেলাম জীবনের কঠিন এক শিক্ষা। বুঝলাম—প্রকৃতি, ভ্রমণ ও মানুষের অচেনা আন্তরিকতা মানুষকে মানসিকভাবে শক্ত করে তোলে। যার জন্য বেরিয়েছিলাম, তার স্মৃতি কয়েক দিনেই মিলিয়ে গেল। আর যে বন্ধু পাশে ছিল, যে কষ্ট আর আনন্দ ভাগাভাগি করেছিল, সে আমার জীবনে নেই। কিন্তু সে–ই আজ স্মৃতির পাতায় অমলিন হয়ে রয়ে গেছে।

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়