প্রবাসের স্বপ্ন বনাম নির্মম বাস্তবতা
বড় শ্রমবাজার হলেও প্রতারণার জাল বিছিয়ে রেখেছেন প্রতারকেরা। এই ফাঁদে পা দিয়ে অনেকেই সর্বস্ব হারাচ্ছেন। অনেকের স্বপ্ন চুরমার হতে দেখেছি।
প্রবাসজীবন যেমন ত্যাগের, তেমনি আনন্দেরও। একদিকে পরিবারের মায়া–মমতা বিসর্জন দিয়ে তাঁদের মুখে হাসি ফোটানোর লড়াই, অন্যদিকে নিজের মূল্যবান সময়কে কাটিয়ে, অবসরবিহীন দিনরাত একাকার করে পাহাড়সম কষ্টের এক নীরব আর্তনাদ। প্রথমবার প্রবাসের মাটিতে পা ফেলা ছেলেটির আত্মত্যাগ তো সীমাহীন। যেমন দেশে থাকাবস্থায় একজন প্রবাস গমনেচ্ছু ছেলেটির যখন প্রবাসের সুর বেজে ওঠে এবং ধাপে ধাপে সব প্রসেসিং সম্পন্ন হতে থাকে। সবশেষ ফ্লাইটের তারিখটাও যখন খুবই সন্নিকটে এসে যায়, ঠিক তখনই এই ছেলেটির বু্ক ধড়পড় করতে শুরু করে। মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন সবাইকে ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা ঘুরঘুর করতে থাকে হৃদয়ের গহিনে।
প্রবাসে আসার সময়ের কথা মনে পড়লে হৃদয়ে কম্পন সৃষ্টি হয়। বিদেশে পাড়ি জমানোর পর বুঝেছি ভিসা ছয়জন দালালের হাতবদল হয়ে আমার হাত পর্যন্ত পৌঁছেছিল। দেশে থাকাকালীন বুঝিনি বা জানার কোনো উপায়ও ছিল না। যাঁর মাধ্যমে সৌদি আরব আসি, সে আমার পাশের গ্রামের একজন লোক, আব্দুল্লাহ (ছদ্মনাম)। সৌদিতে থাকে প্রায় পাঁচ বছর ধরে। এলাকার লোকজন নম্র–ভদ্র হিসেবে তাকে চেনে। প্রথমে তার সঙ্গে ফোনে সখ্য গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে কথা পাকাপোক্ত এবং ভিসার দাম চার লাখ টাকা ধার্য করা হয়। সৌদিতে ভালো একটি চকলেট কোম্পানিতে কাজের আশ্বাস দেয় সে। কিন্তু আমার পরিবার নিম্নবিত্ত হওয়ায় টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হয়েছে।
পরবর্তী সময়ে তার কথায় বিশ্বাস রেখে ও আশ্বাসে সাড়া দিয়ে চার লাখ টাকা আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ঋণ নিই। এদিকে আমার অভিভাবক সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ওই লোককে স্পষ্টভাবে জিজ্ঞেস করেন, চকলেট ফ্যাক্টরি কি না। তাতেও সে বলেছে বিশ্বাস রাখেন, টেনশনের কিছু নেই। তার কথায় শতভাগ বিশ্বাস রাখি এবং সময়ে সময়ে এজেন্সিকে টাকা দিয়েছি। কখনো পঞ্চাশ হাজার, কখনো এক লাখ দিয়ে সব টাকা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরিশোধ করি। বিদেশে আসার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে পোশাক ক্রয় করে, সর্বশেষ আমাকে দেখতে আসা স্বজনদের মিলনমেলা থেকে বিদায় নিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখে, অভিভাবককে নিয়ে ঢাকায় রওনা হই। ঢাকায় এজেন্সি থেকে কাগজপত্র বুঝিয়ে নিতে এসে চরম দুর্ব্যবহারের শিকার হতে হয়েছিল। এজেন্সির অফিসে থাকাবস্থায় বিভিন্ন অজুহাতে টাকা হাতিয়ে নেয় তারা। তারপর বহু অনুরোধ ও নাকানিচুবানির পর ওই দিন গভীর রাতে শাহজালাল বিমানবন্দরে এসে উপস্থিত হই।
সৌদি আরব আসার পর
রাজধানী রিয়াদের কিং খালেদ এয়ারপোর্ট থেকে আমাদেরকে মালাজ নামক শহরের, কোম্পানির একটি রুমে নিয়ে আসে একজন ড্রাইভার। নিজের টাকায় খাবার কিনে খেতে খেতে এক মাস পার হয়ে গেল। আব্দুল্লাহকে জিজ্ঞেস করা হলে আজ না কাল বলে দুই মাস পার করে দেয়। কিসের চকলেট ফ্যাক্টরি, কাজের কোনো খবর নেই। লোকটি বাস করে আল বিসা শহরে (ইয়েমেন বর্ডারে)। আমার থেকে বহুদূরে। কিছুদিন পর জানতে পারি, আমার ভিসা সাপ্লাই কোম্পানির; এমনকি যে ভিলায় আছি, এটাও একই কোম্পানির। সাপ্লাই কোম্পানির বৈশিষ্ট্যই হলো, লোকজনকে অন্য কোথাও চড়া দামে বিক্রি করে নিজেরা ফায়দা লুটে নেওয়া। যেখানে কাজ করলে বেতন পাওয়া যায় না। শুধুই হতাশার চাদরে আবৃত থাকতে হয়।
চাকরি পেতে সময়ক্ষেপণ হওয়ায় আব্দুল্লাহর অসৎ চরিত্র ও ভয়ানক খবরের কথা একে একে জানতে পারি। আমি যে ভিসায় এসেছি, সেই ভিসা ছয়জন দালালের হাত ধরে আমার হাত পর্যন্ত এসেছে। এটা স্পষ্টই অনুমান হয় যে ওত পেতে বসা দালালগুলো সবাই কিছু টাকা পকেটে ঢুকিয়েছে। এমনকি সৌদি আসার পর কাজ না পাওয়ায় পাঁচজন দালালের সঙ্গে কথা বলি। পরবর্তী সময়ে নিজেই খোঁজখবর নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে অন্য একটি কোম্পানিতে ট্রান্সফার হই। প্রায় চার বছর ধরে এই কোম্পানিতে কাজ করছি। ভালো বেতনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশে চাকরি করছি।
তবে স্বচক্ষে দেখা আমার থেকে আরও বড় ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন অসংখ্য প্রবাসী। প্রতারণা–বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে রাস্তায় শুয়ে থাকতেও দেখেছি।
প্রবাসজীবনের বাস্তবতা
প্রবাসে আসার পর একজন প্রবাসীকে নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়। ছোট্ট একটা স্যুটকেস, কয়েক সেট জামাকাপড় নিয়ে আসা ছেলেটা হয়তো কল্পনাই করেনি এমন সমস্যায় ভুগবে। ভাষা না বোঝা, বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে চলাফেরা, নিজে রান্নাবান্না করা, টাইম টু টাইম ডিউটি করা, চাইলেই পরিবারের সঙ্গে কথা বলার সময় না পাওয়া ইত্যাদি। দেশে থাকাকালে নিজের মা হয়তো কাপড় ধুয়ে দিতেন, রান্না করে খাওয়াতেন। ঘুম থেকে উঠিয়ে দিতেন। কিন্তু প্রবাসে আসার পর সবকিছু নিজেকে করতে হয়। প্রাথমিক অবস্থায় কষ্ট হলেও ধীরে ধীরে এসব সহ্য করে নিতে হয়। মূলত প্রবাসীদের জীবনে যে কষ্ট লুকিয়ে থাকে, তা বাইরের চোখে সহজেই ধরা পড়ে না, কিন্তু দেশে থাকা পরিবার–মানুষজন মনে করে প্রবাসে পৌঁছাতে পারলেই হলো। টাকা এমনিতেই চলে আসবে। কষ্টের মধ্যে ডুবতে থাকা ছেলেটার ভাবনা, তাঁরা বুঝতেই পারে না কীভাবে সে দিনাতিপাত করে। এত কিছুর পরেও হাল না ছেড়ে পরিবারকে সুখে রাখতে, ছেলেটা তাঁর সর্বস্ব দিয়েও নিজ মুখ থেকে উফ শব্দও বলে না।
বাংলাদেশ থেকে যাঁরাই প্রবাসে আসেন, অধিকাংশই ধার বা ঋণ করেন। আবার কেউ কেউ ব্যাংক থেকে ঋণ তোলে ভিসা প্রসেসসহ সবকিছু করেন। পরবর্তী সময়ে প্রবাসের আয় দিয়ে তা পরিশোধ করেন। বিশ্বের নানা দেশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছেন বাঙালি প্রবাসীরা। কারও গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে, কারও মালয়েশিয়া, কেউ আবার ইউরোপ কিংবা আমেরিকায়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রবাসীরা সবচেয়ে বেশি আসেন কাজের উদ্দেশ্যে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার হলো সৌদি আরব, বর্তমানে তিরিশ লাখের বেশি বাঙালি দেশটিতে কর্মরত আছেন।
বড় শ্রমবাজার হলেও প্রতারণার জাল বিছিয়ে রেখেছেন প্রতারকেরা। এই ফাঁদে পা দিয়ে অনেকেই সর্বস্ব হারাচ্ছেন। অনেকের স্বপ্ন চুরমার হতে দেখেছি। ঋণের বোঝার ভার সইতে না পেরে আত্মহত্যা করার জন্য প্রস্তুতিও দেখেছি। পরিবারের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা ও প্রিয়জনের মুখে হাসি ফোটানোর আশা নিরাশায় পরিণত হতে দেখেছি। প্রবাসে আসা ছেলেটা যদি বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়, তাহলে এর চেয়ে দুঃখ আর কী আছে।
দালাল চক্র মিথ্যা প্রলোভনে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী আনে ঠিকই, কিন্তু কাজ দিতে না পারার কারণে হতাশাগ্রস্ত হয়ে নিজেকেই হন্যে হয়ে কাজ খুঁজতে হয় অনেক প্রবাসীকে। অন্য দেশের লোকজন এখানে এসে নিজ নিজ কর্মস্থলে স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করতে পারেন। তাঁদের অধিকাংশই কম খরচে আসে। কোনো দুর্ভোগ পোহাতে হয় না, কাজের ব্যাপারে কোনো টেনশন করতে হয় না। অন্যদিকে বাঙালিদের ক্ষেত্রে পুরো উল্টো চিত্র দেখা যায়।
রিয়াদ, সৌদি আরব