এক বিকেলের ট্রেনযাত্রা ও জীবনের অসমাপ্ত ব্যথা
বেলা ১টা ৩০ মিনিটে বনলতা এক্সপ্রেসে উঠলাম ঢাকা থেকে রাজশাহীর পথে। অফিসের কাজে যেতে হবে, ভেবেছিলাম ট্রেনে উঠে আরাম করে লাঞ্চ করেই যাত্রা শুরু করব। কেবিনে বসে ব্যাগ গুছিয়ে ঠিক করলাম—ওয়েটার এলেই খাবার অর্ডার দেব। কিন্তু বিমানবন্দর স্টেশন পেরোনোর পর যখন ওয়েটার এল, তখনই জানলাম এই ট্রেনে লাঞ্চ সার্ভিস নেই।
হঠাৎ যেন মনে হলো পেটের ক্ষুধার থেকে নিজের পরিকল্পনা ভেঙে যাওয়ার ক্ষুধাটাই বেশি কষ্ট দিচ্ছে। একটু বিরক্ত লাগছিল, একটু অস্বস্তিও। অফিসের তাড়াহুড়া, দুপুর না খেয়ে যাত্রা—সব মিলিয়ে মনের ভেতর একটা অদৃশ্য চাপ তৈরি হয়েছিল।
ঠিক তখনই সামনে বসা সহযাত্রীদের আলাপচারিতা কানে এল। তাঁদের সঙ্গে ছিল একটি ছোট্ট মেয়ে—অপরিণত রোদ্দুরের মতো নিষ্পাপ, নিশ্চুপ। কথা শুনে জানা গেল, জন্মের মাত্র চার দিনের মাথায় তার মা মারা গেছেন। চার দিনের শিশুর জীবনে এমন নির্মম সূচনা!
আমি তাকিয়ে রইলাম মেয়েটির দিকে। প্রশ্নহীন চোখ। অজানা ভবিষ্যৎ। তার সেই ছোট্ট হাতের নড়াচড়া যেন জীবনের প্রতি একপ্রকার অনুরোধ, ‘আমাকে দেখো, আমাকে আগলে রেখো।’
আর তখনই আমার নিজের দুই মেয়ের মুখ ভেসে উঠল মনে—চার বছরের ফারিজা আর আট বছরের ফাইজা। আমার সব অসহযোগিতা, অভিযোগ, বিরক্তি মিলিয়ে এক মুঠো লজ্জা অনুভব করলাম। কত ছোট কারণে আমরা অস্থির হই, বিরক্ত হই, অভিমান করি। অথচ কারও জীবনে জন্মের মুহূর্ত থেকেই নেমে আসে অন্ধকার, এক অদেখা বেদনা।
ট্রেন তখন দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে উত্তরবঙ্গের দিকে। জানালার বাইরে ছুটে চলা খেত, গাছ, নদী আর গাঁয়ের ঘরগুলো হঠাৎ যেন জীবনের কঠিন সত্যগুলো মনে করিয়ে দিচ্ছিল—
জীবন সব সময় পরিকল্পনা অনুযায়ী চলে না।
সব ক্ষুধা খাবারের নয়, সব কষ্ট ট্রেনের সার্ভিস নিয়ে নয়।
কিছু কষ্ট জন্মের প্রথম চার দিনেই আজীবন ছাপ ফেলে দেয়।
সেই ছোট্ট মেয়েটিকে দেখে মনে হলো—জীবন সত্যিই কতটা বেদনাময় হতে পারে এবং একই সঙ্গে কতটা দৃঢ়, প্রতিদিনের সংগ্রামে ভর করে টিকে থাকে। আমার বিরক্তি মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। তার পরিবর্তে এক অদ্ভুত শান্তি, এক গভীর উপলব্ধি তৈরি হলো—
আমরা যে জীবনটাকে এত সহজে নষ্ট করি অভিযোগে, তাতে আসলে কত বিস্ময় ও বেদনার মিশ্রণ লুকানো থাকে!
ট্রেন এগিয়ে চলল আর আমি ভাবলাম—হয়তো এই যাত্রাই আমাকে মনে করিয়ে দিল, কতটা কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত আমার নিজের দুই সন্তানের জন্য, তাদের সুস্থ জীবন, তাদের নিরাপত্তা আর প্রতিদিনের হাসির জন্য।
জীবন কখনো কখনো আমাদের সামনে অদৃশ্য আয়না তুলে ধরে। আজ বনলতা এক্সপ্রেস সেই আয়নাটাই তুলে ধরেছিল।
সহসভাপতি, বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ