যাত্রাপথে দেখা মানবিকতার এক মূর্ত প্রতীক

ছবি: এআই/বন্ধুসভা

এক জরুরি কাজে গিয়েছিলাম ছোট চাচার বাড়ি রংপুরে। ফেরার পথে সাক্ষী হলাম এক চমকপ্রদ ঘটনার। সূর্য তখন পশ্চিমে ঢলে পড়ছে। একটি আন্তজেলা বাসে উঠলাম। বাস ছাড়তে তখনো কয়েক মিনিট বাকি—তাই বেশ কিছু সিট ফাঁকা, তবে যুগল আসন খালি নেই। আমি একা ছিলাম। খুব একটা অসুবিধা ছাড়াই সিটে গিয়ে বসলাম। শরীর তখন সামান্য ক্লান্ত, চোখ দুটো আধবোজা, ঘুমঘুম ভাব ভর করছিল।

এরই মধ্যে বাসে উঠল চার সদস্যের একটি পরিবার—স্বামী-স্ত্রী, একটি বাচ্চা ছেলে ও বারো-তেরো বছরের একটি মেয়ে। সিট একেকটা করে ফাঁকা থাকায় সবাই আলাদা আলাদা বসল—মা সামনে, বাবা মাঝখানে ছেলেকে কোলে নিয়ে আর একদম পেছনে বসল মেয়েটি।

আমার চোখে পড়ল মেয়েটি। অদ্ভুত শান্ত, সংযত, ব্যতিক্রমী, সৌন্দর্যে যেন চন্দ্র সমতুল্য। বয়সে ছোট হলেও তার চোখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি। আঠারো পার করা এক তরুণ হিসেবে তার সেই নিষ্পাপ, নির্মল চোখের দিকে তাকিয়ে বারবার মন সরে যাচ্ছিল। কিন্তু বয়স আর নৈতিকতার বাঁধন মনে করিয়ে দিল—এ তাকানো নয়, এ শ্রদ্ধার স্থান।

বাস চলতে শুরু করল। ভাড়া তোলার সময় কন্ডাক্টর এসে বলল, ‘এই মেয়েটার ভাড়া লাগবে, সিট দখল করলে টাকা দিতে হবে।’ মেয়েটির বাবা দায়িত্বহীনভাবে বিষয়টি এড়িয়ে গেলেন; কেবল দুটো সিটের ভাড়া দিলেন। মনে হলো ঘটনা এখানেই শেষ, কিন্তু না—এখানেই শুরু হলো এক অনন্য মানবিকতার গল্প।

কিছুক্ষণ পর বাসটি আরেক স্টপেজে থামল। কিছু যাত্রী উঠল, কিন্তু ফাঁকা সিট নেই। তাই কন্ডাক্টর মেয়েটিকে উঠে দাঁড়াতে বলল এবং এক নারী যাত্রীকে সেখানে বসিয়ে দিল। মেয়েটির বাবা তখন সিট থেকে উঠে মেয়েকে বললেন, ‘এখানে এসে বসো।’
মেয়েটি বাবার প্রতি মমতায় ভরা কণ্ঠে বলল, ‘তুমি আমার ব্যাগটা রাখো, আমি দাঁড়িয়ে যাব।’
তবু বাবাকে প্রশ্ন করল না, ‘বাবা, তুমি আমার সিটের ভাড়া দাওনি কেন? তাহলে তো উঠে যেতে হতো না!’

তার চোখে ছিল ক্লান্তি। তাতে ফুটে উঠছিল বাবার প্রতি শ্রদ্ধা, দায়বদ্ধতা আর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা।

আরও পড়ুন

আমি তখন নির্বাক, অন্য এক জগতে ডুবে ছিলাম। ঠিক তখনই বাসের হর্নের শব্দে চমকে উঠলাম। দেখি মেয়েটির কাছেই দাঁড়িয়ে আছে ছয়-সাত বছরের দুই শিশু—চলন্ত বাসে ঝাঁকুনিতে পড়ে যাচ্ছিল। মেয়েটি নিজেকে সামলাতে সামলাতে বলল, ‘ভালো করে ধরো, পড়ে যেয়ো না যেন।’

একসময় পরবর্তী স্টপেজে কিছু যাত্রী নেমে যাওয়ায় সিট খালি হলো। মেয়েটি নিজে না বসে সেই শিশু ছেলে দুটিকে সিটে বসিয়ে দিল। নিজের চাহিদা যেন মহানুভবতা ও মানবতার কাছে ক্ষুদ্রসম। নিজে দাঁড়িয়ে থেকেও অন্যদের বসার সুযোগ দিল—নীরবে, অকৃত্রিমভাবে। যদিও চোখেমুখে ছিল ক্লান্তির ছাপ।

আমি কল্পনায় তখন অনেক কিছু ভাবছিলাম। বিবেক আমাকে প্রশ্ন করছিল, আমি কি এতটুকু মানবিক হতে পারি?
অবশেষে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘তুমি বসো।’
হয়তো তখনো আমার বিবেকের কিছুটা অংশ বেঁচে ছিল। যদিওবা আমার বিবেক জাগ্রত হওয়ার মুহূর্তে গল্পটির সমাপ্তির ঘণ্টা বেজে গিয়েছিল।

যাত্রা শেষে যখন বাস তাদের গন্তব্যে পৌঁছাল, বাবা বললেন, ‘লাবণ্য, আমরা এসে গেছি।’
আমার কানে যেন নামটি গেঁথে গেল—লাবণ্য!
আমি থেকে গেলাম এক অভূতপূর্ব ঘটনার নীরব সাক্ষী হয়ে, ভাবুক এক ভ্রমণকারীর মতো।

সাংগঠনিক সম্পাদক, দিনাজপুর বন্ধুসভা