সেই স্মৃতি এখনো তাঁকে তাড়া করে ফেরে

বন্যার সেই দিনগুলো যেন ছিল প্রকৃতির রোষের এক নির্মম খেলাফাইল ছবি: আনিস মাহমুদ

২০২২ সালের সেই বিভীষিকাময় বন্যা এখনো মাহমুদা বেগমের চোখে ভেসে ওঠে—নদীর মতো ছুটে আসা সেই পানি, রাতের অন্ধকারে ডুবে যাওয়া ঘর, আর নিজের চোখের সামনে সবকিছু ধ্বংস হয়ে যেতে দেখা।

সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রামে বসবাস করতেন মাহমুদা বেগম। সেই গ্রামের মাটি, ঘর, উঠান—সবকিছু মিলিয়ে গড়ে উঠেছিল তাঁর সংসার। কিন্তু একটানা কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যায় মুহূর্তেই যেন সবকিছু পাল্টে যায়।

‘আমার কোন্তা নায় ভাই, হকলতা পানিতই ভাইসা গেসে গি’— কণ্ঠে বেদনার ভার আর চোখে কান্না নিয়ে বলছিলেন মাহমুদা বেগম। তিন সন্তানের এই জননী তাঁর স্বামীকে হারিয়েছেন বহু বছর আগে। এর পর থেকে একাই সন্তান লালনপালন করছেন। ‘আমি ঘর বান্ধসি, ক্ষ্যাত করসি, গরু পালসিলাম। যেগুন আছলো হখলতা দি করসি, তিনডা পোলাপুরিরে মানুষ করানির চেষ্টা করছি। আমার কোন্তা আর রইল না।’

বন্যার সেই দিনগুলো যেন ছিল প্রকৃতির রোষের এক নির্মম খেলা। জুনের মাঝামাঝি সময়ে টানা কয়েক দিনের ভারী বর্ষণের পর হঠাৎ করেই পানি বাড়তে শুরু করে। প্রথমে গ্রামের নিচু এলাকাগুলো ডুবে যেতে থাকে। গ্রামের মানুষ কেউই প্রস্তুত ছিল না এত বড় দুর্যোগের জন্য। সবাই ভেবেছিল গত বছরের মতো একটু পানি উঠবে। কিন্তু এইবার এক দিনে উঠান থেকে বিছানা পর্যন্ত উঠে গেল পানি। মাহমুদা বেগমের ঘরে কোমরপানি পর্যন্ত ছিল।

মাহমুদা বেগম বলেন, ‘পানি আইবার আগ টাইমও কোনো সরকারি মাত হুনসি না আর এলাকার মাইনসে কোন্তা কইসে না। ইতার দায় এলাকার কেউ কোন্তা হালাইতে পারসে না। আমার ঘরওর সব ফার্নিচার, পিন্দনের কাপড়, চাইল-ডাইল, গরু-বাছুর- কোন্তা বাচাইতাম পারছি না। খালি তিনডা পুরুতারে কোলোও খরি কোনো লাখান উঁচা জায়গাত লইয়া গেসি।’

বন্যার সময়কার সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বলার সময় চোখে জল চলে আসে তাঁর।
‘পুরু পোলাডার তখন তাপ(জ্বর) আছলো। খাকও করি পানি ভাঙ্গিয়া হাঁটছি। এক হাতও ওইটারে ধইরা রাখসি, অন্য হাতও বড় পুরিটারে। হেবলা মনোও হইছিল, আইজ বুঝি জীবন শেষ হই যাইব।’
আসলে নিজের চোখে দেখা, বন্যায় পানির চাপে শুধু ঘরবাড়িই নয়, ভেঙে যায় গ্রামের রাস্তা, নষ্ট হয় পানির উৎস ও শৌচাগার। অনেকেই আশ্রয় নিয়েছিল স্কুলে, কেউ গিয়েছিল আত্মীয়ের বাড়িতে।
‘আমরা স্কুলও গিয়া উঠিসি। ইলা মানুষ আসলো ইনো, না খাইয়া থাকন লাগত বেশির ভাগ টাইমও। ইলা বেইল গেসে হুকনা মুড়ি আর পানি খাইয়া দিন কাটাইসি,’ বলেন মাহমুদা বেগম।

বন্যা কমার পর ঘরে ফিরেও আর কিছুই অবশিষ্ট পাননি মাহমুদা বেগম। বলেন, ‘ঘরও হামাইয়া দেখি গিয়া—খালি প্যাক আর মাটির বয়(গন্ধ) করে। ছকির তলে হাপের গাতা। ফ্রিইজ, চকি, সন্দুক হকলতা বাদ। গরু ইকছিন মরেছে, খ্যাড় শুকাইয়া ভাসি গেছে। কিছু বড় মাইনসে সাহায্য দিসইন তবে যেতা দিসে ওতা দি আমরার কোন্তা হইসে না। খানি কিতা কইন ঘরই বানাইতাম পারসি না। ওখনও আধা ভাঙা ঘরও পলিথিন দিয়া ছাউনি দিয়া ওকটাত থাকতাসি।’

এই দুর্যোগ শুধু একটি পরিবার নয়, শত শত পরিবারকে নিঃস্ব করেছে। এর মধ্যেও মাহমুদা বেগমের মতো নারীরা সবচেয়ে বেশি ভুগেছেন। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘পোলাইন তো বাইরে যাইতে পারোর, আমরা পুরিন্তের তো ঘরও থাকা লাগে। পানি উঠিলে কিলা রান্ধিমু, কিলা পুরিন্তেরও পোলাইন্তরে খাওয়াইমু—সব চিন্তা আমরার মাথাত থাকে।’

বন্যার পর বহু পরিবার গ্রাম ছেড়ে শহরের দিকে চলে গেছে। কিন্তু মাহমুদা বেগম থেকে গেছেন। ‘আমিও জাগাত হইসি, ওনই মরতাম চাইরাম। ইলা কষ্ট যেন আর কেউর না দেখন লাগে।’

বর্তমানে মাহমুদা বেগম স্থানীয় এনজিওর সহায়তায় একটি ছোট দোকান চালাচ্ছেন। সেই আয়ের মাধ্যমে কোনোরকমে পরিবারের খরচ চলে। বলেন, ‘আগর লাখান আর শক্তি নায়, পুরতাগুলার লাগি, ইতার মুখ বায় চাইয়া চলরাম ওখনো।’

২০২২ সালের সেই স্মৃতি এখনো তাঁকে তাড়া করে ফেরে। বন্যার পানি সরে গেলেও রেখে গেছে না মুছে যাওয়া দাগ—মন আর মাটিতে। মাহমুদা বেগম বলেন, ‘মেঘ দেখলে আমি এখনো বেতালা ডর ডরাই। মনও হই যার, আরোকবারওর লাখান যদি পানি আয়…।’

সভাপতি, মুরারিচাঁদ কলেজ বন্ধুসভা