নেতৃত্ব কি শুধু ক্ষমতা, নাকি দায়বদ্ধতা

সত্যিকারের নেতৃত্বের জন্য প্রতিশ্রুতি প্রয়োজনছবি: এআই/বন্ধুসভা

যখন নেতারা দায়িত্ব নেন, তখন তাঁরা শুধু কোনো কাজ হাতে নেন না; পুরো পরিস্থিতির কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন। সমস্যা যেন ঠিকমতো সমাধান হয় এবং সব কাজ সমন্বয় করে চলে—তার জন্য প্রয়োজন হলে তাঁরা এমন দক্ষতা ব্যবহার করেন যা আগে তাঁদের ছিল না, বা খুব দ্রুত নতুন দক্ষতা শিখে নেন।

কিন্তু দক্ষতার চেয়েও দায়িত্ববোধ একধরনের মানসিকতা। দায়িত্ববোধ হলো কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানসিক শক্তি। দায়িত্ববান হওয়া মানে সমালোচনা সহ্য করা ও নিজের বিশ্বাসের পক্ষে দাঁড়াতে পারা। একই সঙ্গে, শুধু নিয়ম মেনে চলাই নয়—পরিস্থিতির বাইরে গিয়ে ভাবা, হিসাব করে ঝুঁকি নেওয়া, কল্পনাশক্তি ব্যবহার করা এবং প্রয়োজনীয় পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।

অবশ্যই, ভুল সবাই করে। অনেক সময় নেতারা মনে করেন, তাঁদের ভুল করা উচিত নয়, বা ভুল করলে তা যেন বোঝা না যায়। তখন কেউ কেউ সত্য গোপন করেন, পিছিয়ে যান, দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপান বা অজুহাত দেন।

কিন্তু দায়িত্ববান নেতারা ভুল স্বীকার ও সেটি ঠিক করার চেষ্টা করেন। তখন মানুষ তাঁদের এই সততা ও ভুল সংশোধনের উদ্যোগকে সম্মান জানায়। একজন নেতা কতটা দায় স্বীকার করেন—এটি ভবিষ্যতে মানুষ তাঁকে কীভাবে দেখবে, তা অনেকটাই নির্ধারণ করে।

দায়িত্ব একটা পরীক্ষা। আপনি কি নিজেকে সৎ হিসেবে দেখাতে পেরেছেন? আপনি কি যথেষ্ট শক্তিশালী ও দূরদর্শী? সংকট বড় হওয়ার আগেই এগিয়ে গিয়ে সমস্যা সামলাতে পারেন? কারণ, নেতৃত্বে ‘বিশ্বাস’ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যখন সেই বিশ্বাস নষ্ট হতে শুরু করে, তখন নেতা যতই ব্যাখ্যা বা অজুহাত দিক—মানুষ আর তা গুরুত্ব দিয়ে শোনে না। তখন একটা নেতিবাচক চক্র তৈরি হয়। আরও ব্যাখ্যা, আরও অজুহাত, আরও বিশ্বাস কমে যাওয়া। ছোট সমস্যা বড় হয়ে বিশাল সংকটে রূপ নেয়। অথচ শুরুতে সৎ থাকলেই এতসব জটিলতা এড়ানো যেত।

আরও পড়ুন

দায়িত্ববান নেতারা জানেন, কীভাবে বিশ্বাসভঙ্গের কারণে তৈরি হওয়া সংকট ঠেকাতে হয়। তাঁরা চিন্তা করেন—সহযোগীরা কী জানতে চাইবে, কীভাবে তাঁদের আস্থা ধরে রাখা যায়। এর জন্য মানুষকে বোঝা, তাঁদের সঙ্গে মিলে কাজ করা, যাতে তাঁরা সম্মানিত অনুভব করেন। এসব জরুরি।

আবার দায়িত্বের মানে শুধু সমস্যা মোকাবিলা নয়। একটি প্রতিষ্ঠান, প্রকল্প, বা সংগঠন যেন নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে পারে এবং সবাই কর্মে মনোযোগী, সন্তুষ্ট ও দক্ষ থাকে—সেটাও দায়িত্বের অংশ। এর মধ্যে আছে সমস্যা সমাধান, নতুন কর্মীদের পথ দেখানো এবং দীর্ঘমেয়াদি উন্নতির দিকে নজর রাখা। যদিও এখন অনেক নেতা নিজেদের শুধু ‘সমস্যা সমাধানকারী’ হিসেবে দেখেন, দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতি দিতে চান না। তবে সত্যিকারের নেতৃত্বের জন্য প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন।

আমি যেসব নেতাকে পরামর্শ দিই, তাঁদের বলি, নেতৃত্বকে একটি সম্পর্কের মতো ভাবতে। এখানে প্রতিশ্রুতি মানে হলো সব পরিস্থিতির প্রতি সতর্ক থাকা এবং সমস্যা এলে তা মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকা। নেতা কখনো বলতে পারেন না—‘আমি শুধু এই সমস্যা ঠিক করতে এসেছি, প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য আমার বিষয় নয়।’ এমন মনোভাব মানুষকে মোটেও অনুপ্রাণিত করে না। তখন কেউ–ই আন্তরিকভাবে তাঁর প্রতি প্রতিশ্রুতি দেখাতে চান না।

নেতার মনোভাব হওয়া উচিত—‘যা-ই ঘটুক না কেন, আমরা একসঙ্গে আছি।’ অর্থাৎ যেসব সমস্যা এখন নেই, ভবিষ্যতে হতে পারে, সেগুলোর দিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

একজন নেতার শেষ দায়িত্ব হলো নতুন নেতৃত্বের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করা। এটি সহজ নয়। কারণ, কেউ নিজের বিদায়ের পরিকল্পনা করতে পছন্দ করেন না। তবু একজন ভালো কাউকে ভবিষ্যতের নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত করতে হবে। দায়িত্ব ছাড়ার আগেই তাঁর পাশে দাঁড়াতে হবে। এসব গুণের চর্চাই একজন ব্যক্তিকে সত্যিকারের নেতা বানায়।

সূত্র: সাইকোলজি টুডে

লেখক: অ্যারন ফ্রিডবার্গ, এমডি; মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, মাউন্ট সাইনাই আইকান স্কুল অব মেডিসিনের ক্লিনিক্যাল প্রফেসর এবং একাডেমি ফোরামের সম্পাদক; ম্যানহাটান, যুক্তরাষ্ট্র।