শৃঙ্খলা আর ব্র্যান্ডিং—দুই মাসেই ফ্রিল্যান্সিংয়ে আয় সম্ভব

বন্ধুসভার বন্ধুদের তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে আগ্রহী করে তুলতে এবং প্রযুক্তির বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানাতে প্রথম আলো বন্ধুসভা প্রথমবারের মতো আয়োজন করেছে ধারাবাহিক টেক শো। বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড অনার মোবাইলের সৌজন্যে প্রতি সপ্তাহের বুধবার রাত ৮টা ৩০ মিনিটে শুরু হয়ে ৯টা পর্যন্ত এই টেক শো অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ৩১ জুলাই অনুষ্ঠিত হয় ১৩তম পর্ব।

প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাস করেও এখন অনেকেই ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে ভালো আয় করছেনছবি: এআই/বন্ধুসভা

বর্তমান সময়েও কাজ শেখার দেড়-দুই মাসের মধ্যে ফ্রিল্যান্সিংয়ে আয় করা সম্ভব। এর জন্য প্রচুর মনোযোগী হতে হবে। শৃঙ্খলা লাগবে। ফ্রিল্যান্সার ও তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা সুবীর নকরেক বলেন, ‘আমি বলব, সঠিক ব্র্যান্ডিংটা করতে হবে। শুধু দক্ষতা অর্জন করলে হয় না। যেমন আমি যদি একজন পেশাদার গ্রাফিক ডিজাইনার হই, কিন্তু আমাকে কেউ চেনে না; তাহলে আমাকে কেউ কাজটা দেবে না। প্রথমত, নিজেদের দক্ষতাকে মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে। সঠিকভাবে পৌঁছাতে পারলে কাজের অভাব হবে না। আর যাঁরা শুধু মার্কেটপ্লেসে মনোযোগ দেন, তাঁদের কাজ পেতে কিছুটা সময় লাগে। কিন্তু যাঁরা লিংকডইনে নিজের পেশাদার প্রোফাইল খুলে পারসোনাল ব্র্যান্ডিং করেন, এক্সে নিজের মার্কেটিং করেন; তাঁরা প্রশিক্ষণের দুই মাসের মধ্যেও উপার্জন করতে পারেন।’

প্রথম আলো বন্ধুসভার ভার্চ্যুয়াল টেক শোর ১৩তম পর্বে আলোচক হিসেবে যুক্ত ছিলেন ফ্রিল্যান্সার ও তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা সুবীর নকরেক। আলোচনার বিষয় ছিল ‘ফ্রিল্যান্সিং ফর ফ্রিডম: টেক স্কিল চেঞ্জিং লাইভস’। বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড অনার মুঠোফোনের সৌজন্যে ৩১ জুলাই রাত সাড়ে আটটায় এটি অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানটি বন্ধুসভার ফেসবুক পেজ থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। সঞ্চালনা করেন বন্ধুসভা জাতীয় পর্ষদের সহসভাপতি রুবাইয়াত সাইমুম চৌধুরী।

আরও পড়ুন

ফ্রিল্যান্সার হিসেবে যাত্রা
আলোচনার শুরুতেই ফ্রিল্যান্সার হিসেবে নিজের যাত্রা শুরুর গল্প শোনান সুবীর নকরেক। বলেন, ‘ঢাকায় পড়াশোনার জন্য প্রায় ১৬ বছর ছিলাম। এরপর চাকরিসূত্রে চলে যাই ময়মনসিংহ। সেখানে জাইকার একটি প্রকল্পে এক বছর কাজ করার পর বেকার হয়ে যাই। প্রকল্পের মেয়াদ আর বাড়ানো হয়নি। চিন্তা করলাম, যদি সরকারি চাকরি ছাড়া অন্য কোনো চাকরিতে মনোযোগ দিই, তাহলে এ রকম বিভিন্ন কারণে হয়তো কাজগুলো একটা সময় বন্ধ হয়ে যাবে। নতুন কিছু করার চিন্তা এল। ভাবলাম, আইটি খাতে কিছু করা যায় কি না। এরপর গ্রামে ফিরে যাই।

‘এক বছর গ্রামে থাকি। বিভিন্ন ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করি। একদিন মা জিজ্ঞেস করলেন, “চাকরি শেষ হয়ে গেছে বলে এভাবে গ্রামেই কি সারা জীবন কাটাবা নাকি?” জবাবে বললাম, গ্রামে তাহলে কৃষিকাজ করা যায়। তখন মা-বাবা বললেন, “তুমি এমবিএ শেষ করে আসছ, আবার বলছ গ্রামে কৃষিকাজ করবা। কৃষিকাজ করার জন্য তো এত পড়াশোনা না করলেও চলত। তোমাকে নিয়ে আমরা অনেক বড় স্বপ্ন দেখি। তুমি চাইলেই ঢাকায় গিয়ে পড়াশোনা করে বিসিএস ক্যাডার হতে পারবা।” ওনাদের বলেছি, আমার আসলে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার কোনো আগ্রহ নেই। আমি চাই আইটি সম্পর্কিত কাজ করতে। ওনারা আইটি কী জিনিস জানতেন না। তাই বললেন, “আমরা এসব কিছু জানি না। তোমাকে বিসিএস ক্যাডার হতে হবে। তুমি ঢাকায় চলে যাও।”

‘এরপর বিসিএস কোচিং করার জন্য টাকা নিয়ে ঢাকায় এসে গ্রাফিক ডিজাইন কোর্সে ভর্তি হয়ে গেলাম। এটা শুনে মা–বাবা হতাশ হয়েছিলেন। ফ্রিল্যান্সিং বিষয়ে ওনাদের কোনো ধারণা ছিল না। রাগ করে বাবা আমার সঙ্গে এক সপ্তাহ কোনো কথা বলেননি। এর দেড় মাস পর অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক একটা কোম্পানি থেকে ৭৫ ডলারের একটা কাজ পাই। এভাবেই শুরু।’

বনে বসে সুবীরের ডলার আয়
টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার বনাঞ্চলের বনের মধ্যে গায়রা নামে একটি গ্রাম রয়েছে। সেখানেই বাড়ি সুবীর নকরেকের। যখন তিনি ফ্রিল্যান্সিং শুরু করেন, তখন সেই গ্রামে ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক তেমন ছিল না। কোথাও কোথাও পাওয়া গেলেও সেটা টু-জি। এই আইটি উদ্যোক্তা বলেন, ‘কেবল কোনো খোলা মাঠে গেলে ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক পাওয়া যেত। দেখা গেল, ১০ এমবির একটা ফাইল আপলোড করতে প্রায় দুই ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে। আমার মতো আরও যাঁরা ছিলেন, তাঁরাও একই সমস্যা পেতেন। এরপর সবাই মিলে সরকার ও টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানিগুলোতে আবেদন করতে থাকি। কেউ এগিয়ে আসেনি। এরপর প্রথম আলো এগিয়ে আসে। তারা আমাদের গ্রামে এসে সরেজমিনে সবকিছু দেখে প্রতিবেদন করল। সেই সুবাদে একটি টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি থেকে ফোর-জি নেটওয়ার্ক পাই।’

ফ্রিল্যান্সিং কোনো চাকরি নয়, এটা দক্ষতার একটি ব্যবসা বলে মনে করেন সুবীর নকরেক। তিনি বলেন, ‘আমাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে যাঁরা প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কাজ শিখছে; শেখার পর তাঁরা কেবল নিজেরাই আয় করছেন না, আরও অনেককে এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা পেতে গড়ে তুলছে। এভাবে সমাজে অবদান রেখে চলেছে।’

অনার-বন্ধুসভার ধারাবাহিক লাইভ টেক শো (১৩তম পর্ব)।

‘গুগলের তথ্যানুসারে সারা বিশ্বে বর্তমানে প্রায় ১৫৭ কোটি ফ্রিল্যান্সার রয়েছে। তাঁরা ৪৬ দশমিক ৭ শতাংশ বৈদেশিক অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে এটা ৫০ শতাংশ হয়ে যাবে। প্রথম আলোর তথ্যানুসারে, বর্তমানে বাংলাদেশে ১৫ লক্ষাধিক ফ্রিল্যান্সার আছেন। তাঁরা দেশে এক বিলিয়ন ডলারের মতো বার্ষিক রেমিট্যান্স নিয়ে আসছেন,’ যোগ করেন সুবীর।

সফল ফ্রিল্যান্সার হতে হলে
এই সময়ে এসে যে কেউ স্বাধীনভাবে নিজের মতো দক্ষতা উন্নয়ন করে এগিয়ে যেতে পারেন। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় সবচেয়ে বেশি জরুরি বলে মনে করেন সুবীর নকরেক। তিনি বলেন, ‘এক. পেশাগত দক্ষতা। যে ক্যাটাগরিতে কাজ করতে চান, সেই ক্যাটাগরিতে দক্ষ হতে হবে। দুই. সফট স্কিল অর্থাৎ যোগাযোগ দক্ষতা। যোগাযোগ দক্ষতা মানে এই নয় যে আপনাকে ইংরেজিতে এক্সপার্ট হতে হবে। নিজের কাজের জায়গাটা ক্লায়েন্টকে বোঝাতে পারছেন কি না বা ক্লায়েন্টদের চাহিদা বুঝতে পারছেন কি না। এই দুইটা দক্ষতা অর্জনের পর পারসোনাল ব্র্যান্ডিংয়ের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।’

প্রথমত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের প্রোফাইলকে প্রফেশনালি সাজাতে হবে। দ্বিতীয়ত, ধরুন, আপনি আমেরিকান ক্লায়েন্টের সঙ্গে কাজ করতে চান। তাহলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমেরিকান মানুষদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন (ফেসবুক, টুইটার কিংবা লিংকডইন)। এই তিনটা প্ল্যাটফর্মকে আগামী এক মাসের জন্য টার্গেট করুন, যাতে প্রতি দিন অন্তত দুজনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন। এভাবে এক মাসে প্রায় ৬০ জন বিদেশি বন্ধু বানালেন। এই মানুষেরা দেখবেন আপনি আপনার প্রোফাইলে কী করছেন।’

তৃতীয়ত. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের প্রোফাইল সাজানোর পর প্রথম সপ্তাহে এআই দিয়ে লোগো সম্পর্কিত গবেষণা ও সেই অনুযায়ী নিজেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া; দ্বিতীয় সপ্তাহে অ্যাডপ ফটোশপ কিংবা অ্যাডপ ইলাস্ট্রেটর, অথবা এর চেয়ে যেকোনো সহজ, ক্যানভা হতে পারে। এভাবে দুই সপ্তাহের মধ্যে লোগো নিয়ে পেশাদারের মতো দক্ষ হয়ে ওঠা সম্ভব। তৃতীয় সপ্তাহে এই কাজগুলোকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করতে হবে।’

সুবীর নকরেক বলেন, ‘এগুলো প্রচার করার সময় অনেকে অনেক কিছু বলতে পারে। পাত্তা দেওয়া যাবে না। এভাবে একটা সময় অনেকে কাজ দেখে আপনাকে কাজের জন্য নক দেবে। প্রথমে স্থানীয় বন্ধুরা কাজের জন্য নক দেবে। ধীরে ধীরে বিদেশি বন্ধুরাও নক দেওয়া শুরু করবেন।’