ফ্রিল্যান্সিংয়ে সফল হতে কী কী জরুরি? সুযোগ ও সম্ভাবনা

বন্ধুসভার বন্ধুদের তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে আগ্রহী করে তুলতে এবং প্রযুক্তির বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানাতে প্রথম আলো বন্ধুসভা প্রথমবারের মতো আয়োজন করেছে ধারাবাহিক টেক শো। বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড অনার মোবাইলের সৌজন্যে প্রতি সপ্তাহের বুধবার রাত ৮টা ৩০ মিনিটে শুরু হয়ে ৯টা পর্যন্ত এই টেক শো অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ১০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয় ১৯তম পর্ব।

ফ্রিল্যান্স করাটা সাধারণ চাকরির পেশা থেকেও অনেক কঠিনছবি: এআই/বন্ধুসভা

ফ্রিল্যান্সিং করার চিন্তা কখনোই ছিল না ২২ বছর বয়সী শুভ সরকার ও তাঁর ছোট ভাই ১২ বছর বয়সী সৈকত সরকারের। কিন্তু পরিস্থিতিতে পড়ে বেঁচে থাকার জন্য মানুষকে অনেক কিছুই করতে হয়। শুভ সরকার বলেন, ‘এটাকে সার্ভাইভিং বলেন কিংবা স্ট্রাগল, আমার যে দক্ষতা ছিল, সেটাকে বিক্রি করার জন্যই ফ্রিল্যান্সিংয়ে আসা।’ মাত্র ১৮ বছর বয়সে এ পেশায় পা রাখেন তিনি।

বর্তমানে শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজিতে পড়াশোনা করছেন শুভ সরকার। পাশাপাশি ছোট ভাই সৈকত সরকারকে নিয়ে থ্রি–ডি অ্যানিমেশন ও প্রোডাক্ট অ্যানিমেশনের কাজ করছেন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সৌদি আরব, নিউজিল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে। নিজেরা একটি ডিজিটাল এজেন্সি করেছেন, যার নাম পিক্সিহেক্স।

প্রথম আলো বন্ধুসভার ভার্চ্যুয়াল টেক শোর ১৯তম পর্বে আলোচক হিসেবে যুক্ত ছিলেন এই দুই ভাই। তরুণ এই উদ্যোক্তা ও ফ্রিল্যান্সাররা কথা বলেন এত অল্প বয়সে নিজেদের এ পেশায় যাত্রা নিয়ে। পাশাপাশি যাঁরা ফ্রিল্যান্সিংয়ে আসতে চান, তাঁদেরও জন্যও দিয়েছেন পরামর্শ।

আরও পড়ুন

বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড অনার মুঠোফোনের সৌজন্যে ১০ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে আটটায় এই টেক শো অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনার বিষয় ছিল, ‘দ্য ফিউচার অব ফ্রিল্যান্সিং: অপরচুনিটিস ইন দ্য ডিজিটাল ইকোনমি’। অনুষ্ঠানটি বন্ধুসভার ফেসবুক পেজ থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। সঞ্চালনা করেন ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার সাধারণ সম্পাদক হাসান মাহমুদ সম্রাট।

শুভ সরকার জানান, তাঁর শেখার যাত্রা শুরু হয় গ্রাফিকস ডিজাইন দিয়ে। এই দক্ষতাকে আরও বাড়ানোর জন্য ক্রিয়েটিভ আইটিতে থ্রি–ডি বা মোশন গ্রাফিকসের ওপর কোর্স করেন। ওখানে কিছুটা শেখা হয়। এরপর যা কিছু শিখেছেন, সব নিজে গবেষণা করে। তরুণ এই উদ্যোক্তা বলেন, ‘যখন কম্পিউটারে কাজ করতাম, তখন ছোট ভাই আশপাশেই থাকত। গেমস খেলতাম প্রচুর, ওর এদিকে ইন্টারেস্ট ছিল প্রচুর। যখন কাজ করতাম, তখন সে পাশে বসে বসে সেগুলো দেখত। ওরও এভাবেই ধীরে ধীরে কম্পিউটারের প্রতি ঝোঁকটা আসে। তখন মনে হলো কাজগুলো শিখালে সে হয়তো ভালো করবে। এভাবে ওকে ডিজাইনিংয়ে আনি। ওর শুরুটা হয় থ্রি–ডি থেকে। অন্যদিকে আমার শুরু ছিল গ্রাফিকস ডিজাইন থেকে।’

সৈকত সরকার বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই জানার আগ্রহটা বেশি। অন্যদের কপি করার চেষ্টা করতাম। ভাইয়ার কাজগুলো দেখতাম এবং নিজেও সেগুলো করার চেষ্টা করতাম। থ্রি–ডির কাজ চেষ্টা করার পর ভাইয়া আরেকটু ভালো কনফিগারেশনের কম্পিউটার এনে দেয়। তার পর থেকে পুরোদমে কাজ শুরু করলাম।’

নতুন ফ্রিল্যান্সাররা কোন দক্ষতা নিয়ে শুরু করলে দ্রুত কাজ পাবে?
ফ্রিল্যান্সিংয়ে আসার আগে কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে। এ পেশায় সফলতা পেতে চাইলে শুরুতে অন্তত দুই-আড়াই বছর সময় হাতে রাখতে হবে বলে জানান শুভ সরকার। তিনি বলেন, ‘দ্রুত সফলতা পাওয়ার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। যদিও কিছু খাতে কম সময় দিয়ে ভালো কিছু করা যায়। বিশেষ করে মার্কেটিং ও ডিজাইন খাতে তুলনামূলক একটু দ্রুত সময়ের মধ্যে কাজটা পাওয়া যায়। সৃজনশীল ও ডেভেলপমেন্ট খাতে কাজগুলো একটু কঠিন হয়।’

‘যারা ভালো কিছু করতে চায়, তাদের বলব সৃজনশীল খাতে মনোযোগ দিতে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ধৈর্য থাকা। কারণ, এ পেশায় চাকরির মতো তেমন সিকিউরিটি থাকে না। আপনি যখন কাজ করবেন, তখন সেটার পেমেন্ট পাবেন,’ যোগ করেন শুভ।

যে কাজটা ফ্রিল্যান্সারদের অবমূল্যায়ন করা যাবে না
যোগাযোগ দক্ষতায় অনেক ভালো হতে হবে। চেষ্টা করতে হবে ক্লায়েন্টের সঙ্গে যোগাযোগটা যেন ঠিক থাকে। এটা সোলো ফ্রিল্যান্সারদের ক্ষেত্রে। আর যখনই এটা এজেন্সির মাধ্যমে হবে, তখন যোগাযোগটা আর একক পথের থাকে না। একাধিক বিষয় দেখতে হয়। পেমেন্ট নিয়ে হতে পারে, রিভিশন নিয়ে হতে পারে। এই সবকিছুর জন্য কারিগরি দক্ষতার পাশাপাশি যোগাযোগ দক্ষতা খুবই ভালো হতে হবে। অন্যথায় এ পেশায় দীর্ঘ সময় টিকে থাকা কঠিন।

অনার-বন্ধুসভার ধারাবাহিক লাইভ টেক শো (১৯তম পর্ব)।

চ্যালেঞ্জ
আমাদের দেশে পেমেন্ট–সম্পর্কিত ব্যাপারটায় একটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। পেপাল, স্ট্রাইকসহ পেমেন্ট গেটওয়ের কমন অপশনগুলো বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। শুভ সরকার বলেন, ‘আমাদের এটা নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়েছে। আমার যাত্রা শুরু হয় ফাইবার থেকে। বিপুল পরিমাণ একটা অর্থ প্রতি মাসে জমা হতো। কিন্তু ফাইবার নির্দিষ্ট একটা পরিমাণ অর্থ চার্জ হিসেবে কেটে নেয়। এমনকি ক্লায়েন্টদের কাছ থেকেও তারা চার্জ নেয়। অন্যদিকে পেমেন্ট গেটওয়ের অপশনগুলো আমাদের দেশে থাকলে ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে পুরো অর্থটাই আমরা পেতে পারতাম।’

ইন্টারনেটের একটা সমস্যা এখনো রয়েছে গেছে বলে জানান তিনি। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে থেকে কাজ করতে গেলে ফাইল ডাউনলোডে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। আরেকটা সমস্যা হচ্ছে, বাংলাদেশে হার্ডওয়ারের দাম প্রচুর। তরুণ এই ফ্রিল্যান্সার বলেন, ‘আমরা যারা থ্রি–ডি নিয়ে কাজ করি, যে ডিভাইসটা আমাদের দরকার, অনেক বেশি রিসোর্স লাগে। যেমন ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে কাজ করতে গেলে একটা লাইটওয়েট ল্যাপটপ হলেই চলে। থ্রি–ডির ক্ষেত্রে রিসোর্সের শেষ নেই। এখানে যে যত বেশি বিনিয়োগ করতে পারবে, তার জন্য তত ভালো। একটা গ্রাফিকস কাডের দাম হয়তো বিদেশে ৫০ হাজার টাকা; সেই একই জিনিস বাংলাদেশে এলে হয়ে যাচ্ছে ৭০-৮০ হাজার টাকা।’

ফ্রিল্যান্সিংয়ে শটকাটভাবে অর্থ উপার্জনের কোনো সুযোগ আছে?
জীবনে কোনো কিছুতেই শটকাট বলে কোনো পথ নেই। সবকিছুর একটা সময় আছে। সময় হলেই সাফল্য ধরা দেয়। ফ্রিল্যান্স করাটা সাধারণ চাকরির পেশা থেকেও অনেক কঠিন। এ পেশায় নিজেকেই সেলসম্যান হতে হবে, নিজেকেই মার্কেটার হতে হবে, নিজেকেই ফাইন্যান্স এক্সপার্ট হতে হবে, আবার নিজের মধ্যে কারিগরি দক্ষতাও থাকতে হবে।

নতুনদের জন্য পরামর্শ
শুভ সরকার বলেন, নিজের মধ্যে পটেনশিয়াল থাকতে হবে। প্রচুর গবেষণা করতে হবে। যেমন আজকে আমি গ্রাফিকস ডিজাইন চেষ্টা করলাম, আচ্ছা ঠিকাছে পরেরদিন একটু ডেভেলপমেন্ট খাতে দেখি যে ওখানে আমার ভালো লাগে কি না। এভাবে নিজের ভালো লাগার জায়গাটা খুঁজতে হবে। সেটা হতে পারে ক্রিয়েটিভ খাত কিংবা ডেভেলপমেন্ট খাত। সেটির ওপর বিশ্লেষণ করে সামনে আগাতে হবে। পাশাপাশি বিভিন্ন মার্কেটপ্লেস যেমন ফাইবার, আপওয়ার্ক—এই ধরনের প্লাটফর্মগুলোতে দেখতে হবে যে কোন ধরনের কাজ বেশি পোস্ট হচ্ছে।