বন্ধুদের স্মৃতিতে অম্লান জুবায়ের কবির তুষার

জুবায়ের কবির তুষার।

২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনার সময়ের কথা। ভবন ধসের কথা জানার পরপরই তুষার বলল, ‘অনির্বাণ, আমাদের সেখানে যেতে হবে। মানুষকে সহায়তা করতে হবে।’ এদিকে আমাদের কোনো পরিকল্পনা নেই, কিছুই নেই। যাওয়ার জন্য কোনো গাড়িও পাইনি। তারপর একটা ট্রাকে করে চলে গেলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সেখানে গিয়ে আমরা কী করব?’ সে বলল, ‘কিছুই না। সেখানে গিয়ে স্যালাইন কিনব, পানি কিনব।’ তারপর কাকে কাকে যেন ফোন দিয়ে সে কয়েক কেস পানি সংগ্রহ করে ফেলল। আমাদের পকেটে কিন্তু টাকা নেই। সেভাবেই ঘটনাস্থলে চলে গেলাম।

এই যে কোনো কিছু চিন্তা করার আগেই কাজে নেমে পড়া, নিজ থেকে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া, অনেক সহজভাবে কঠিন কঠিন কাজ করে ফেলা—এই বিষয়গুলো তুষারকে অনন্য করে তোলে বলে জানান তাঁর বন্ধু অনির্বাণ অনি।

২ সেপ্টেম্বর ছিল বন্ধু জুবায়ের কবির তুষারের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। দিনটি উপলক্ষে তাঁর স্মরণে ‘তুমি রবে স্মরণে’ শিরোনামে স্মরণসভার আয়োজন করে প্রথম আলো বন্ধুসভা। রাত সাড়ে আটটায় ভার্চ্যুয়ালি অনুষ্ঠিত এই সভায় যুক্ত হয়ে অনির্বাণ বলেন, ‘আমাদের চিন্তা থেকে তুষারের চিন্তা সব সময় একটু ভিন্ন ছিল। সবকিছু সহজ করে ফেলা, সবকিছুকে সহজভাবে নেওয়া। আমাদের কাছে যেটা কঠিন মনে হচ্ছে, সে বলত এটা হয়ে যাবে। হয়ে যাবে বলে কাজে নেমে পড়ত।’

সভার সঞ্চালনা করেন সাংবাদিক ও গবেষক আশফাকুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘তুষার এমন একজন মানুষ ছিল, যে সবার কথা ভাবত। মনের দিক থেকে অনেক সমৃদ্ধ ছিল। একজন সাধারণ মানুষও যে নেতা হতে পারে, মানবিক মানুষ হতে পারে—এইটা কিন্তু আমরা তুষারের মধ্যে পেয়েছি। সে অনেক আশাবাদী একজন মানুষ ছিল। সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। এটা অনেক বড় ব্যাপার।’

বন্ধু জুবায়ের কবির তুষারের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ‘তুমি রবে স্মরণে’ শিরোনামে স্মরণসভা।

বন্ধুসভায় দীর্ঘ দেড় দশক ধরে জুবায়ের কবির তুষারের সঙ্গে কাজ করেছেন সজীব মিয়া। দুজন খুবই ভালো বন্ধু ছিলেন। সজীব মিয়া বলেন, ‘তুষার যে নাই, এখনো বিশ্বাস করা কঠিন। মনে হয়, এমনিতেই হয়তো ওর সঙ্গে যোগাযোগ কমে গেছে। সে কখনো অন্য কাউকে নিয়ে কুৎসা রটনা করত না। কাউকে সমালোচনা করা, তাচ্ছিল্য করা—এসব ওর মধ্যে ছিল না। তুষারের কাছ থেকে এই বিষয়গুলো আমাদের শেখার আছে।’ এ সময় তিনি তুষারের সঙ্গে পরিচয়, বন্ধুত্ব, একসঙ্গে বেড়ে ওঠা এবং হিমু পরিবহন প্রতিষ্ঠার পেছনের গল্প নিয়ে স্মৃতিচারণা করেন।

জুবায়ের কবিরের তুষারের প্রিয় ফুল ছিল শিউলি ও কদম। গত বছর তাঁর মৃত্যুর পর কবরের পাশে এই দুটি গাছ রোপণ করা হয়েছিল। সেগুলো এখন অনেকটাই বড় হয়েছে। মৃত্যুবার্ষিকীর দিন কুষ্টিয়ার মিরপুরে কবর জিয়ারত করতে গিয়ে সে কথা স্মরণ করেন বন্ধু হাসান ইমাম। বলেন, ‘গ্রামের তরুণ থেকে মুরব্বি—সবার মধ্যে এখনো তুষারকে নিয়ে আলোচনা। সবাই তাঁর ভালো কাজগুলো নিয়ে কথা বলে। মানুষের মধ্যে এভাবেই ভালোবাসা ছড়িয়ে গেছে তুষার।’

আরও পড়ুন

বন্ধুসভা জাতীয় পর্ষদের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন মল্লিক বলেন, ‘২০০৬ সালে নওগাঁ বন্ধুসভার মাধ্যমে আমার পথচলা। তখন ঢাকা থেকে যাঁরা যোগাযোগ করত, তাঁদের মধ্যে অন্যতম তুষার ভাই। বন্ধুসভার কাজে উনি নওগাঁয় আসতেন। কাজের পাশাপাশি ওনার সঙ্গে আমরা জেলার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে যেতাম। উনি বলতেন, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর বৃষ্টি হয় বাংলাদেশে। আমাদের দেখা সবচেয়ে পজিটিভ মানুষ তিনি। সবাইকে অনুপ্রাণিত করতেন।’

সিলেট বন্ধুসভার সাবেক সভাপতি শাহ সিকান্দার শাকির। স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘যখন সিলেট বন্ধুসভার দায়িত্ব নিলাম, তখন তুষার প্রায়ই নক দিয়ে বলত, তোমার কাজগুলো আমি দেখি। খুবই ভালো হচ্ছে। আমাদের এমনকিছু করতে হবে, যাতে সবাই স্মরণ রাখে। বলত, গাছ লাগাও যে, এগুলো ফেসবুকে শেয়ার দিবা। আমি বলতাম, শেয়ার দিলে অনেকেই অনেক কথা বলে। তিনি বলতেন, মানুষের কথায় কান দেওয়া যাবে না। নিজের কাজ করে যেতে হবে। ভালো কাজ চারদিকে ছড়িয়ে দিতে হবে।’