‘আমাদের ভালো কাজের মধ্য দিয়ে তুষার বেঁচে থাকবে’

জুবায়ের কবির তুষার স্মরণে স্মরণসভা ‘তুমি রবে স্মরণে’ছবি: শাকিব হাসান

‘তুষারের মধ্যে একটা পাগলামি ছিল। বই পড়তে হবে, লাইব্রেরি করতে হবে। জিজ্ঞেস করতাম, কোথায় করতে হবে? বলত, সারা দেশে। সে সব সময় বলত, “আমাদের বুকের মধ্যে বাংলাদেশ। বন্ধুসভার বন্ধুদের বুকের মধ্যে বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশ আমাদের গড়ে তুলতে হবে।” সে তরুণদের নিয়ে কথা বলত। সরলভাবে সবাইকে ভালোবাসত। তুষার একটা অনুপ্রেরণার নাম। যখন বন্ধুসভায় ছিল; আমরা বলতাম, তুষার আমাদের ভরসা, তুষার আমাদের শক্তি। তাঁর সব ভালোকে আমরা গ্রহণ করে নেব।’

৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় সদ্য প্রয়াত প্রথম আলো বন্ধুসভার বন্ধু জুবায়ের কবির তুষার স্মরণে আয়োজিত স্মরণসভায় এ কথা বলেন বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সভাপতি সাইদুজ্জামান রওশন। প্রথম আলো কার্যালয়ের সভাকক্ষে ‘তুমি রবে স্মরণে’ শিরোনামে এটি অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন তাঁর বন্ধু, সহকর্মী, শুভাকাঙ্খী ও বন্ধুসভার বন্ধুরা।

শুরুতেই জুবায়ের কবির তুষার স্মরণে বন্ধুসভার বন্ধু আবু সাঈদের লেখা ‘আমাদের একজন তুষার ছিল’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন আলাদিন আসাদ। তাহসিন আহমেদ পাঠ করে শোনান বন্ধু আশফাকুজ্জামানের স্মৃতিচারণামূলক লেখা ‘ওপারে ভালো থেকো তুষার’।

‘তুষারের ইতিবাচকতা, দেশপ্রেম, হাসি—সব ভালো দিক আমরা মনে রাখব।’
কথাসাহিত্যিক ও প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক

কথাসাহিত্যিক ও প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক বলেন, ‘তুষারের সুন্দর মুখটা সব সময় মনে পড়ে। ওর মতো ইতিবাচক, আলোকিত হৃদয়ের একজন মানুষ আমাদের ছেড়ে এত দ্রুত চলে যাবে, এটা অপ্রত্যাশিত ছিল। মেনে নেওয়া যায় না। খুবই দুঃখ থেকে যাবে। ৩৫ বছর বয়স একদম মৃত্যুর বয়স না। তুষারের ইতিবাচকতা, দেশপ্রেম, হাসি—সব ভালো দিক আমরা মনে রাখব।’

লেখক ও গবেষক আশফাকুজ্জামান বলেন, ‘তুষার সত্যিকারের একজন মানুষ ছিল। সে মানুষের কথা ভাবত, সংগঠনের কথা ভাবত। সবাইকে উৎসাহ দিয়ে যেত। মাঝেমধ্যে অবাক লাগে এই ভেবে যে একজন মানুষ এত কিছু কীভাবে ভাবতে পারে! সে স্বপ্নের কথা বলত। ওর স্বপ্ন অনেক বড় ছিল। যে মানুষ যত বেশি বিনয়ী, সে তত বেশি ভালো মানুষ। তুষার সেই মানুষ। সে হারিয়ে যেতে পারে না। আমাদের কাজে, হৃদয়ে ও মননে থেকে যাবে।’

‘তুষার প্রথম দিন বন্ধুসভায় এসে যেভাবে সবার সঙ্গে মিশেছিল, প্রাণোচ্ছল ছিল; তার দিকে নজর দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। কোনো কাজ দিলে তুষার কখনো “না” বলত না। বলত, “করে ফেলব ভাই।” ঝুঁকি নেওয়ার ইচ্ছাশক্তি ও সাহস ছিল ওর। তুষারের হাসিমুখটা মিস করব,’ বলছিলেন তাঁর সঙ্গে দীর্ঘদিন বন্ধুসভায় কাজ করা শেখ আল মামুন।

তুষারদের আদর্শ বন্ধুসভার কাজের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকবে বলে জানান বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি জাফর সাদিক
ছবি: শাকিব হাসান

জুবায়ের কবির তুষারের দীর্ঘদিনের বন্ধু জাহিদ হোসাইন খান জানান, তাঁরা দুই বন্ধু ২০০৮ সালের ২৮ অক্টোবর প্রথমবার ঢাকায় প্রথম আলো অফিসে আসেন। এর পর থেকে ২০১৬ সালে লেবাননে যাওয়ার আগপর্যন্ত বন্ধুসভায় নিয়মিত কাজ করে গেছেন তুষার। এমনকি বিদেশে চলে যাওয়ার পরও দেশের মানুষের কথা তিনি কখনো ভোলেননি। সব সময় সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। সবার সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক রাখতেন। জাহিদ হোসাইন খান বলেন, তুষার সত্যিকারের একজন ইনফ্লুয়েন্সার ছিলেন।

স্মৃতিকথা বলতে গিয়ে সবাই আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। এখনো শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি কেউ। কথা বলার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের নির্বাহী সভাপতি মৌসুমী মৌ। তিনি বলেন, ‘ভালো সময়, খারাপ সময়—প্রতিটি মুহূর্তে তুষার ভাই পাশে ছিলেন। ওনার সঙ্গে খুব একটা দেখা-সাক্ষাৎ না হলেও নিয়মিত খোঁজখবর নিতেন। উৎসাহ দিতেন। ছোট-বড় যেকোনো অর্জনে খুশি হতেন।

জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন মল্লিক বলেন, তুষার ভাই ভালো বিষয়গুলো খুঁজে বের করতেন। ক্ষুদ্র জিনিসগুলো বড় আকারে করার চেষ্টা করতেন।

তুষার সত্যিকারের একজন মানুষ ছিল বলে মনে করেন লেখক ও গবেষক আশফাকুজ্জামান
ছবি: শাকিব হাসান

প্রায় সবার কথায় একটি বিষয় একই ছিল, তুষারের মধ্যে অনেক পাগলামি ছিল। সবই ভালো কাজের জন্য। এ নিয়ে একটি গল্প বলেন বন্ধু রুহুল আমিন রনি। তিনি বলেন, প্রতিবছর প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনে তুষার সকালে গোসল করতেন, নতুন পায়জামা-পাঞ্জাবি পরতেন। তারপর অফিসে এসে রওশন ভাইকে (সাইদুজ্জামান রওশন) সালাম করে অনুষ্ঠানে যেতেন। বলতেন, এটা তাঁর আরও একটি ঈদের দিন। রুহুল আমিন রনি আরও বলেন, তুষারের মধ্যে নেতৃত্বের সেরা গুণাবলি ছিল। যখন যে কাজ করতেন, নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করতেন।

বায়েজিদ ভূঁইয়া বলেন, তুষার সব সময় কাজ করতে চাইতেন। এ জন্যই হয়তো অল্প সময়ে অনেক কাজ করে গেছেন। তাঁর মধ্যে কোনো ইগো ছিল না। কখনো কাউকে অবমূল্যায়ন করতেন না।

প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা বলেন, ‘মাঝেমধ্যে তুষারকে বলতাম, তুই এত ইতিবাচক, এত ভালো থাকিস কীভাবে? ও বলত, “আমি কেউ নই। তোমরা সবাই মিলে কাজ করলে পারবে।”’

রুহুল আমিন রনি বলেন, ‘তুষারের মধ্যে নেতৃত্বের সেরা গুণাবলি ছিল।’
ছবি: শাকিব হাসান

ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার উপদেষ্টা বহ্নি শিখা বলেন, তুষার মানুষের কাছ থেকে ভালোবাসা আদায় করে নিতে পারতেন। এটা বিশাল গুণ। বন্ধুত্ব ধরে রাখতে পারতেন।

বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাসান মাহমুদ বলেন, ‘প্রতিবার দেশে এলে তুষার সবাইকে একত্র করে ফেলত। কীভাবে যেন সে এটা করে ফেলত। ওর কল্যাণে আমরা আবার একত্র হচ্ছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার নেতৃত্ব দেওয়ার গুণাবলি অর্জনে ওর অবদান সবচেয়ে বেশি। যেকোনো দুর্যোগে সে সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়ত। এমনকি কারও দিকনির্দেশনারও অপেক্ষা করত না।’

জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য নর্মদা মিথুন বলেন, ‘তুষার ছিল সহজ-সরল, স্নিগ্ধ–সুন্দর মনের মানুষ। তার ভালো গুণাবলি আমাদের সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ুক। আমাদের ভালো কাজের মধ্য দিয়ে তুষার বেঁচে থাকবে।’

জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য নর্মদা মিথুন বলেন, ‘তুষার ছিল সহজ-সরল, স্নিগ্ধ–সুন্দর মনের মানুষ।’
ছবি: শাকিব হাসান

জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি জাফর সাদিক বলেন, ‘তুষার নিজের কোনো কথা বলতেন না। সারা জীবন অন্যের কাজ, অন্যের অর্জন ভাগাভাগি করে গেছেন। অন্যের সাফল্যে খুশি হতেন। এই জন্যই হয়তো তিনি সবার ভালোবাসার জায়গা দখল করে নিতে পেরেছেন। তুষারদের আদর্শ বন্ধুসভার কাজের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকবে।’

এ ছাড়া জুবায়ের কবির তুষারকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেন পাবনা বন্ধুসভার সাবেক সভাপতি জুয়েল কুমার ঘোষ, কুষ্টিয়া বন্ধুসভার সাবেক সভাপতি সেঁজুতি ভৌমিক, যাত্রাবাড়ী বন্ধুসভার বন্ধু কাজল, জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. রেদোয়ান মাহমুদ রেজা, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক শাকিব হাসান, ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার সাংগঠনিক সম্পাদক শাহরিয়ার নাজিম সীমান্তসহ আরও অনেকে।