স্বাস্থ্যকর জীবনের জন্য সুপার ফুড

বিদ্যুৎ বরণ সাহা উদ্ভাবিত নরি প্লান্টের প্রাইমারি নকশা
ছবি: সংগৃহীত

‘Global Warming’ শব্দের সঙ্গে পরিচিত নয়, এমন শিক্ষিত লোক খুব কমই খুঁজে পাওয়া যাবে। একে পৃথিবীর জ্বর বলে অভিহিত করা যায়। জ্বর হওয়ার অনেক কারণ থাকে, সমাধানও খুঁজতে হয় ওই কারণকে লক্ষ্য করে। যেমন সবচেয়ে বড় একটা কারণ হলো কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া। এই কার্বন ডাই-অক্সাইড কমাতে পারলে পৃথিবীর জ্বর কমলেও কমতে পারে। তাহলে কীভাবে কমানো যায়? একটা উপায় হলো কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের উৎসগুলোকে কমানো বা বন্ধ করে দেওয়া। কিন্তু উৎসগুলো হঠাৎ করে বন্ধ করা সম্ভব নয়, এর সঙ্গে আর্থিক ও সামাজিক অনেক বিষয় জড়িত।

তাহলে কী করা যায়? বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন কার্বন ডাই-অক্সাইডকে কীভাবে বাতাস থেকে সংগ্রহ করা যায়। অনেকেই অনেক সিস্টেম ইতিমধ্যে তৈরি করে ফেলেছেন এবং তার ওপর ভিত্তি করে কাজও করছেন। তারপরও যে প্রশ্নটি চলে আসে তা হলো, এই যে এত এত কার্বন ডাই-অক্সাইড সংগ্রহ করা হলো, তা রাখব কোথায়? এর তো কোনো ব্যবহার নেই। তাহলে উপায়?

এতক্ষণে যা বললাম তা যদি বুঝতে পারেন তাহলে অধ্যাপক সাহার নতুন উদ্ভাবনের গুরুত্ব বুঝতে পারবেন। কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিদ্যুৎ বরণ সাহার আবিষ্কার আবারও জাপানের বিখ্যাত পত্রিকা ও টেলিভিশন প্রকাশ করেছে। জাপানের সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা Nishi Nihon Shimbun এ বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি তাঁর এই কাজ নিয়ে ফিচার আর্টিকেল করেছে। পাশাপাশি সরকারি টেলিভিশন চ্যানেলও তাঁর উদ্ভাবনের খবর ফলাও করে প্রচার করেছে।

উদ্ভাবনটি হলো, কীভাবে কার্বন ডাই-অক্সাইড ব্যবহার করে শৈবাল উৎপাদন করা যায়, যা নেগেটিভ কার্বন ইমিশন হিসেবে কাজ করবে। অর্থাৎ তিনি হাতে–কলমে দেখিয়ে দিয়েছেন সংরক্ষিত কার্বন ডাই-অক্সাইড কীভাবে পরিবেশ রক্ষার্থে ব্যবহার করা যায়। তিনি একটি কমপ্লিট সিস্টেম তৈরি করেছেন, যা দিয়ে ট্যাংকেই উৎপাদন করা যাবে খাওয়ার উপযোগী শৈবাল। সিস্টেমের বিভিন্ন প্যারামিটার (কার্বন ডাই-অক্সাইড প্রবাহ, তাপমাত্রা, পিএইচ ইত্যাদি) আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হবে এবং সিস্টেমটি পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করবে।

জাপানিজরা এই শৈবালকে বলে নরি, বৈজ্ঞানিক নাম হলো Pyropia tenera, ইংরেজিতে বলা হয় ‘লাভার’। জাপানিরা সম্পূরক খাদ্য হিসেবে সব সময়ই নরি খায়। যদিও নরি দেখতে সবুজ, কিন্তু এটি একটি লাল গোত্রের শৈবাল। বিভিন্ন জনপ্রিয় জাপানিজ খাবার যেমন সুশি, অনিগিরি ও মোচিতে নরি ব্যবহার করা হয়। ১৮৯৪ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত নরি উৎপাদনে জাপান শীর্ষ স্থানে ছিল। বিভিন্ন ভেষজ গুণসমৃদ্ধ নরি হয়তোবা তাদের দীর্ঘায়ুর এক গোপন রহস্য।

নরি প্রোটিন, ডায়েটারি ফাইবার, ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, আয়োডিন, বিটা ক্যারোটিন ও অ্যামিনো অ্যাসিড সমৃদ্ধ। এটি অত্যন্ত কম ক্যালোরিসম্পন্ন একটি খাবার। যদি প্রতিদিন অল্প পরিমাণ নরি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা যায়, তবে তা সেই দিনের আয়োডিনের চাহিদা পূরণ করা ছাড়াও ১ দশমিক ২ মিলিগ্রাম ভিটামিন B12–এর চাহিদাও পূরণ করবে। জাপানে নরি সম্বন্ধে একটি কথা প্রচলিত আছে যে ‘Two sheets a day keeps the doctor away’। এ ছাড়া নরির কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ ক্ষমতা অনেক বেশি। বর্তমানে জাপানে প্রতিবছর প্রায় ১৪ হাজার টন নরি উৎপাদিত হয়, যা প্রায় ৫ হাজার ৬০০ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণের জন্য অবদান রাখতে পারে।

এত গেল জাপানের কথা, বাংলাদেশে এর প্রয়োগ কোথায়? যদিও খাদ্য হিসেবে নরি এখনো আমাদের দেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি, তবে অন্য অনেক জায়গায় এর ব্যবহার রয়েছে। প্রথমত, নরি শৈবাল ছাড়াও আরও অনেক রকমের শৈবাল আছে, যা দিয়ে বায়ো ফুয়েল তৈরি করা যায়। এই ফুয়েল তৈরির পর যে উচ্ছিষ্ট থাকবে, তা দিয়ে গবাদিপশুর খাবারও তৈরি করা যায়। এই শৈবাল তৈরির মেশিন ঘরে ঘরে তৈরি করা সম্ভব। এতে শুধু আর্থিকভাবে আমরা লাভবান হব না, বিশ্বকে দেখাতে পারব বাংলাদেশ ধীরে ধীরে কার্বন ডাই-অক্সাইড নামক ব্যোম নির্গমন থেকে দূরে সরে আসছে। আমরা বিশ্ব থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড কমিয়ে দিয়ে নেগেটিভ কার্বন ইমিশন দেশের তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করতে পারি। জানি না আগামী বছরে বিশ্বকে বাঁচানোর সম্মেলনে কী হবে। যা–ই হোক না কেন, বিশ্বকে বাঁচানোর জন্য কার্বন ডাই-অক্সাইড কমানোর যুদ্ধে সবাই শিগগিরই শামিল হবে। হয়তো অধ্যাপক সাহার এই উদ্ভাবন হয়ে উঠবে এক বড় হাতিয়ার।

এ ছাড়া বিদ্যুৎ বরণ সাহার এই শৈবাল–সম্পর্কিত গবেষণাকর্ম জাতিসংঘ প্রণীত ১৭টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (SDGs) মধ্যে ১০টি লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মিলে যায়। এই লক্ষ্যমাত্রাগুলো হলো: এসডিজি ১: দারিদ্র্য বিমোচন, এসডিজি ২: ক্ষুধামুক্তি, এসডিজি ৩: সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ, এসডিজি ৭: সাশ্রয়ী ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি, এসডিজি ৮: উপযুক্ত কাজ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, এসডিজি ৯: শিল্প, উদ্ভাবন ও অবকাঠামো, এসডিজি ১২: পরিমিত ভোগ ও টেকসই উৎপাদন, এসডিজি ১৩: জলবায়ু কার্যক্রম, এসডিজি ১৪: জলজ জীবন এবং এসডিজি ১৭: লক্ষ্য অর্জনে অংশীদারত্ব।

বাংলাদেশের আবহাওয়া স্পিরুলিনা উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী। এটি ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সর্বোচ্চ পরিমাণে উৎপাদিত হয়। অধ্যাপক সাহার উদ্ভাবিত পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রচুর পরিমাণে স্পিরুলিনা উৎপাদন করা যাবে, যাকে সুপার ফুড বলা হয়।

অধ্যাপক সাহার এই কাজে দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মীর শরীফুল ইসলাম। তিনি অধ্যাপক সাহার তত্ত্বাবধানে বর্তমানে পিএইচডিতে অধ্যয়নরত। বিদ্যুৎ বরণ সাহা ও মীর শরীফুল ইসলামের এই পরিশ্রম একদিন আমাদের দেশের জন্যই ভালো কিছু নিয়ে আসবে। সেই আগত সুদিনের অপেক্ষায়।