সম্মিলনে উচ্ছ্বসিত বন্ধুত্বের সাতকাহন

ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার নৃত্য দল বন্ধু সভার থিম সং এর সঙ্গে নৃত্য পরিবেশনা করেন।
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

গল্পের শুরুটা বেশ আগের। গত মাসের মাঝামাঝি সময়ে অনলাইনে বিভাগীয় সাংগঠনিক সভা চলছিল। ঢাকার সব কটি বন্ধুসভা সেই সভায় একযোগে সশরীর একটি উৎসব আয়োজনের দাবি জানাল।

তাৎক্ষণিকভাবে জাহাঙ্গীরনগর ও ড্যাফোডিল বন্ধুসভা উৎসব আয়োজনের দায়িত্ব নিতে আগ্রহ প্রকাশ করল। সভার সম্মিলিত সিদ্ধান্তে এবং জাতীয় পর্ষদের সভাপতি উত্তম রায়ের অনুমতিক্রমে জাহাঙ্গীরনগরকেই উৎসবের ভেন্যু ও আয়োজন সহযোগী হিসেবে বেছে নেওয়া হলো। এরপর জাবি বন্ধুসভার সভাপতি হাসান মাহমুদ সম্রাট প্রয়োজনীয় সব বুকিং সম্পন্ন করলে, ঈদের পরপরই শুরু হয়ে গেল নিবন্ধন। অল্প সময়ের মধ্যেই ঢাকা বিভাগের ৩৪টি বন্ধুসভার ৪৮১ জন বন্ধুর নিবন্ধন যেন প্রত্যাশার পারদে বারুদ জ্বালিয়ে দিল! অতিথি, নিরাপত্তারক্ষী আর অন্য সবাই মিলে যে সংখ্যা পাঁচ শতাধিক!

অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিরা
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

এর কদিন আগেই করোনার প্রবল দাপটে সারা বিশ্বের মতো স্থবিরতার জগদ্দল পাথরে বন্দী ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু তখনো থামেনি বন্ধুদের ভালো কাজের অদম্য যাত্রা। গত দুই বছরে অনলাইন আর ভার্চ্যুয়াল নানা আয়োজনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সারা দেশের বন্ধুদের সরব উপস্থিতিতে মুখর থাকলেও সশরীর জমায়েত হতে না পারার আক্ষেপটা ছিল সবার মধ্যেই। গত মার্চে নতুন পরিচালনা পর্ষদের অভিষেক হওয়ার পর সশরীর বড় কোনো আয়োজনে বন্ধুদের দাবি তাই এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। প্রাথমিক পরিকল্পনায় যা ছন্দে-গন্ধে আর পূর্ণ আবেগে বিকশিত হয়ে পরিণতি লাভ করে গত ২০ মার্চ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি)। আয়োজিত হয় ঢাকা বিভাগীয় বন্ধু উৎসব ২০২২।

এত দিন পর এত বড় একটা আয়োজন, জাতীয় পর্ষদের সভাপতি উত্তম রায়ের কঠোর নির্দেশনা, ‘খরচ যা হওয়ার হবে, অনুষ্ঠানের মানের ব্যাপারে কোনো আপোস নয়।’ তাঁর নেতৃত্বে শুরু হয় সর্বোচ্চ প্রস্তুতি। সাথে মহানগর কমিটির সভাপতি ড. সোলায়মান কবির এবং সাধারণ সম্পাদক ডা. রেদোয়ান মাহমুদ রেজার নেতৃত্বে যুক্ত হন মহানগর কমিটির সদস্যরা। জাতীয় পর্ষদের ম্যাগাজিনবিষয়ক সম্পাদক ফাহমিনা বর্ষাকে সমন্বয়ক করে শুরু হয় নিবন্ধন। মহানগর কমিটির উম্মে হাবিবা, অনিক সরকার ও হৃদয় সৈকত দায়িত্ব নেন সাংস্কৃতিক পর্বের। অন্যদিকে শাকিব হাসানের নেতৃত্বে চলে লজিস্টিকস, ডিজাইন ও অন্য সব দাপ্তরিক ক্রিয়াযজ্ঞ। নির্বাহী সভাপতি মৌসুমী মৌ এককভাবে দায়িত্ব নিয়ে অনলাইন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম চরকিকে বিনোদন সহযোগী হিসেবে যুক্ত করেন। অভিনেত্রী সাফা কবিরসহ চরকির নতুন ফ্লিক ‘হ্যাপি বার্থডে’র কলাকুশলীদের উৎসবে যোগ দেওয়া নিশ্চিত হয়।

উৎসবে অংশগ্রহণকারী বন্ধু ও অতিথিরা
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

সভাপতি উত্তম রায়ের নেতৃত্বে চলতে থাকে পুরো আয়োজনের স্পনসর খোঁজা। একদম শেষ দিকে এসে সিটি ব্যাংককে আয়োজন সহযোগী হিসেবে নিশ্চিত করে দেন প্রথম আলোর বিজ্ঞাপন ও বিপণন বিভাগের উপ-ব্যবস্থাপক এন ডি মিথুন। তরুণদের দক্ষতা উন্নয়নে নিরলস কাজ করে যাওয়া প্রতিষ্ঠান কোডারসট্রাস্ট যুক্ত হয় স্কিল ডেভেলপমেন্ট সহযোগী হিসেবে। অন্যদিকে স্ন্যাকস পার্টনার হিসেবে ড্যানিশ ফুডস লিমিটেড এককথায় রাজি হয়ে যায় জাতীয় পর্ষদের গতবারের বিতর্কবিষয়ক সম্পাদক সজল মিত্র রিচার্ডের অনুরোধে।

ঢাকায় যখন মহানগর আর জাতীয় পর্ষদের কর্মীরা রাত-দিন এক করে কাজ করে চলছেন, তখন জাবিতেও বন্ধুসভার সদস্যরা শোরগোল করে উৎসবে আগত ব্যক্তিদের স্বাগত জানানোর ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। সাজসজ্জা, আলপনা, অভ্যর্থনা, খাবার, নিরাপত্তা ইত্যাদি নানা সব ব্যস্ততায় নাওয়াখাওয়া ভুলে তাঁদের রাতজাগা প্রহরগুলো যেন নিমেষেই পার হয়ে যায়!

অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, ২০ মে সকাল থেকেই ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন স্থান থেকে একে একে বন্ধুরা আসতে শুরু করেন। দ্বিতল দুটি বাস ভরে বন্ধুরা সকাল নয়টায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনের প্রধান ফটকের সামনে থামেন, মুহূর্তে মধ্যে সরগরম হয়ে ওঠে পুরো মিলনায়তন চত্বর। হলুদরঙা টি–শার্ট গায়ে বন্ধুদের কলতানে মুখর হয় সবুজ ক্যাম্পাস। একই সময়ে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক, কিশোর আলোর সম্পাদক ও বন্ধুসভার পৃষ্ঠপোষক আনিসুল হক এবং প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফও উপস্থিত হয়ে যান সস্ত্রীক। আনিসুল হক, সাজ্জাদ শরিফসহ মনোচিকিৎসক ও কথাসাহিত্যিক ডা. মোহিত কামাল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের পরিচালক ড. মোহাম্মদ আলমগীর কবির, কোডারসট্রাস্ট বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর আতাউল গণি ওসমানিসহ অন্য অতিথিদের উপস্থিতিতে বেলুন উড়িয়ে উৎসবের উদ্বোধন করা হয়।

জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে শুরু হয় মূল পর্ব
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

এরপর বন্ধু হৃদয় সৈকত, পৌলমী অদিতি অন্তরা, মেহনাজ বিনতে আমিন, অনিক সরকার, রাহাত তালুকদারসহ অন্য বন্ধুদের সুমধুর কণ্ঠের পরিবেশনায় জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান। উম্মে হাবিবা ডায়নার নেতৃত্বে তাঁর দল বন্ধুসভার থিম সংগীতের সঙ্গে চমৎকার কোরিওগ্রাফিতে মাতিয়ে তোলে বন্ধুদের। প্রথম সেশনে জাতীয় পর্ষদের সাধারণ সম্পাদকের সঞ্চালনায় আলোচনার শুরুতেই জাবি বন্ধুসভার সভাপতি হাসান মাহমুদ সম্রাট আগত বন্ধু ও অতিথিদের স্বাগত জানান। উৎসবের সমন্বয়ক জাতীয় পর্ষদের ম্যাগাজিনবিষয়ক সম্পাদক ফাহমিনা বর্ষা দিনব্যাপী এ আয়োজনে সবার উপস্থিতিতে কৃতজ্ঞতা জানান। নির্বাহী সভাপতি মৌসুমী মৌ বন্ধুদের অক্লান্ত শ্রম আর অদম্য সাহসের জন্য অকুণ্ঠ উষ্ণ ভালোবাসা প্রকাশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়লের যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগের চেয়ারপারসন শান্তা তাওহিদা বন্ধুদের শুভেচ্ছা জানিয়ে উৎসবের সাফল্য কামনা করেন। আতাউল গণি ওসমানি এবারই প্রথম বন্ধুসভার কোনো অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে নিজের মুগ্ধতার কথা জানান এবং যেকোনো আয়োজনে বন্ধুদের পাশে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। ঢাকা মহানগরের সভাপতি ড. সোলায়মান কবীর ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বন্ধুদের ভালোর সাথে আলোর পথে দুর্দমনীয় যাত্রায় শুভাশীষ জানান।

অনুষ্ঠানে বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেন মনোচিকিৎসক ও কথাসাহিত্যিক ডা. মোহিত কামাল, কবি ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক এবং প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও কবি সাজ্জাদ শরিফ
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

এ সময় মনোচিকিৎসক ও কথাসাহিত্যিক ডা. মোহিত কামাল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার বন্ধুদের প্রশংসা করে বলেন, উৎসবে এসে বন্ধুদের দেখে তাঁর মধ্যেও তারুণ্য এসে গেছে। বন্ধুদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘নিজের জীবনকে আলোকিত করার পাশাপাশি অন্যের জীবনকেও আলোকিত করবে। আমি চাই, আমার বন্ধুরা আত্মবিশ্বাসী হবে। আত্মবিশ্বাসী হতে হলে দক্ষতাগুলোকে শাণিত করতে হবে। ঘাটতিগুলো পূরণ করতে হবে।’

সাজ্জাদ শরিফ বন্ধুদের প্রশংসা করে বলেন, ‘বন্ধুসভার বন্ধুরা ভালোবাসতে জানেন, ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতে জানেন। তাঁরা যেভাবে দেশের ক্রান্তিকালে সহযোগিতার হাত বাড়ান, তা অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছে।’

ড. আলমগীর কবির বলেন, ‘বন্ধুসভার বন্ধুরা শিল্প, সংস্কৃতি ও মানবিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে দেশব্যাপী ভালো কাজের মাধ্যমে দেশসেবা করে যাচ্ছেন। বন্ধুদের এই সেবার ব্রতই বাংলাদেশের মানুষের ব্রত হোক।’

এরপর আনিসুল হক বন্ধুসভার বন্ধুদের বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘আপনারা যেখানে যাবেন, এত সুন্দর কাজ করবেন যেন সবাই আপনাদের কাজ অনুসরণ করে। প্রথম আলোর প্রত্যেক বন্ধু আলোর প্রতীক হবে, সমাজকে আলোকিত করবে। বন্ধুসভার সদস্যরা আলোকিত হয়ে বাংলাদেশটা আলোয় আলোয় ভরে তুলব।’ বন্ধুদের বিভিন্ন অবদানের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘কদিন আগে দক্ষিণাঞ্চলে একটা বড় ঘূর্ণিঝড় হলো। তখন বন্ধুরা সেই এলাকায় ছোট নৌকায় করে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে মানুষের কাছে গেছে। একবার বন্ধুসভার বন্ধুরা সারা দিন না খেয়ে ত্রাণসামগ্রী প্যাকেট করে খুলনা অঞ্চলে দিয়ে যাচ্ছে। অনেক পরে আমরা জানতে পারলাম, ওদেরই একটা ছেলের বাড়িতেই খাবার নেই, তবু সে অন্যের বাড়ি খাবার পৌঁছে দিচ্ছে। একটিবারের জন্যও জানায়নি যে আমার বাড়িতে খাবার পৌঁছে দিয়েন। এই হচ্ছে বন্ধুসভা। এরা নিজে খায় না, অন্যকে খাওয়ায়। নিজেদের জীবন বিপন্ন করে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ায় এবং তাদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলে।’

সর্বশেষে জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি উত্তম রায় বন্ধুদের উদ্দেশে বলেন, ‘এমন কিছুই ঘটে না, যেখানে কোনো স্বপ্ন নেই। বন্ধুসভার উদ্দেশ্য হলো একটি গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ সমাজ তৈরি করা, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করবে এবং সহানুভূতিশীল হবে। আমরা বিশ্বাস করি, যে স্বপ্ন নিয়ে বন্ধুসভা গঠন করা হয়েছে এবং প্রথম আলোর যে স্বপ্ন, বন্ধুসভার বন্ধুরা সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য প্রতিনিয়ত কাজ করছি এবং কাজ করে যাব।’

অভিনেত্রী সাফা কবিরের সঙ্গে বন্ধুসভার বন্ধুরা
ছবি: তানজিলুল প্লানা

ড্যানিশ ফুডস লিমিটেডের হেড অব মার্কেটিং মোশারফ হোসেন ভূঁইয়া উপস্থিত হতে না পারলেও বন্ধু উৎসবে যোগ দেওয়া বন্ধু ও অতিথিদের শুভেচ্ছা জানান।

অতিথিদের আলোচনা শেষে ২০২২ সালে সহমর্মিতার ঈদ কার্যক্রমে অংশ নেওয়া সারা দেশের ও দেশের বাইরের ১১৪টি বন্ধুসভার মধ্যে সেরা ১০ বন্ধুসভাকে এবং প্রথম আলোর ছাপা কাগজে ৫০ লাখ পাঠক উদযাপনে সারা দেশের ৪২টি বন্ধুসভার নির্মিত ভিডিও তথ্যচিত্রের মধ্যে সেরা পাঁচ বন্ধুসভাকে ক্রেস্ট ও সম্মাননাপত্র তুলে দেন অতিথিরা। সহমর্মিতার ঈদ কার্যক্রমে সেরা ১০ বন্ধুসভার স্বীকৃতি লাভ করে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ক্যামব্রিয়ান কলেজ, চীন, রংপুর, গোয়ালন্দ, সিলেট, ভোলা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও ঠাকুরগাঁও বন্ধুসভা। আর ভিডিও তথ্যচিত্র নির্মাণে সেরা পাঁচের স্বীকৃতি অর্জন করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয়, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও বগুড়া বন্ধুসভা।

চরকিতে প্রচারিত চরকি ফ্লিক ‘হ্যাপি বার্থডে’ নিয়ে কথা বলছেন সাফা কবির
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

এরপর নির্বাহী সভাপতি মৌসুমী মৌ চরকির সাম্প্রতিক ফ্লিক ‘হ্যাপি বার্থডে’র অভিনেত্রী সাফা কবির, নির্মাতা নিশান মাহমুদ আর নির্বাহী প্রযোজক আদনান মাহমুদকে নিয়ে হাজির হন মূলমঞ্চে। সাফা কবির উপস্থিত বন্ধুদের শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানান। এ সময় চরকির পক্ষ থেকে কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় এবং বিজয়ী পাঁচজনকে পুরস্কার তুলে দেন উপস্থিত অতিথিরা। আর উপস্থিত সবার জন্য চরকির এক মাসের ফ্রি সাবস্ক্রিপশন ঘোষণা করেন।

প্রথম অধিবেশন শেষে দুপুরের খাবারের বিরতিতে বন্ধুরা ক্যাম্পাস ক্যাফেটেরিয়ায় মিলিত হন। সেখানে রাঁধুনিদের তদারকি আর রাতজাগা পরিশ্রমে ক্লান্ত মহানগরের বন্ধু নেওয়াজুল মওলা তাঁর দল নিয়ে হাসিমুখে সবাইকে অভ্যর্থনা জানায়। খাসির কাচ্চির সঙ্গে চিকেন কাবাবের মনমাতানো ঘ্রাণে বন্ধুদের পেট পুরে আহার উৎসবের আনন্দ যেন দ্বিগুণ করে! খাবারের পর বন্ধুরা মেতে ওঠেন ছবি শিকারে। কেউ সেলফি তোলেন তো কেউ আবার নানা ঢঙে কখনো পদ্মপুকুর, কখনো ঘাসে মোড়ানো সবুজ চত্বর, কখনোবা উৎসবের ব্যানার–ফেস্টুনের সামনে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আড্ডা আর হাসি-গল্পের ব্যস্ততায় দ্বিতীয় অধিবেশনের কথাই যেন ভুলতে বসেন বন্ধুরা! সভাপতি উত্তম রায় আর আয়োজকদের বারবার তাড়ায় অবশেষে মিলনায়তনে প্রবেশ করেন বন্ধুরা। প্রায় দেড় ঘণ্টা দেরিতে শুরু হয় দ্বিতীয় অধিবেশন।

অনুষ্ঠানে বন্ধুদের উদ্দেশ্যে এখানে কথা বলেন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব আবদুন নূর তুষার ও কোডারসট্রাস্টের কান্ট্রি ডিরেক্টর আতাউল গনি ওসমানি
ছবি: তানজিলুল প্লানা/ তানভীর আহাম্মেদ

অধিবেশনের শুরুতেই অনলাইন মার্কেটপ্লেস আর ফ্রিল্যান্সিং বিষয়ে বন্ধুদের উদ্বুদ্ধ করেন কোডারসট্রাস্টের কান্ট্রি ডিরেক্টর আতাউল গনি ওসমানি। তিনি বন্ধুদের ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে ঘরে বসে উপার্জনে সক্ষমতা গড়ে তুলতে নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দেন। কোডারসট্রাস্টের পক্ষ থেকে বন্ধুদের জন্য ফ্রি সেমিনার এবং বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কোর্সে ছাড় দেওয়ার ঘোষণাও দেন তিনি। এরপর গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও বন্ধুসভার সাবেক সভাপতি আবদুন নূর তুষার বন্ধুদের উদ্দেশে বিতর্ক ও উপস্থাপনা বিষয়ে কথা বলেন। তিনি বন্ধুদের উপস্থাপনায় পারদর্শী হয়ে সততা ও সাহসিকতার সঙ্গে যেকোনো সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার আহ্বান জানান।

রম্য বিতর্কে কথা বলছেন বন্ধুসভার সভাপতি উত্তম রায়।
ছবি: তানজিলুল প্লানা

‘এখন হৃদয়ের চেয়ে পাকস্থলীর প্রশ্ন জরুরি’—এ বিষয়ে রম্য বিতর্কের মধ্য দিয়ে বিকেল সাড়ে পাঁচটায় শুরু হয় উৎসবের সাংস্কৃতিক পর্ব। এতে জাতীয় পর্ষদের সভাপতি উত্তম রায়, সমতাবিষয়ক সম্পাদক রিদিতা তাহসিন অদিতি, জাবি বন্ধুসভার বন্ধু তাসফিয়া আফরিন ফারিয়া সরকার দলের হয়ে এবং জাতীয় পর্ষদের সাধারণ সম্পাদক জাফর সাদিক, বিতর্কবিষয়ক সম্পাদক এম এস আই খান ও মহানগরের কোষাধ্যক্ষ সাইমুম মৌসুমী বৃষ্টি বিরোধী দলের হয়ে বিতর্ক করেন।

সঞ্চালনা করছেন বন্ধুসভার সাধারণ সম্পাদক জাফর সাদিক।
ছবি: তানজিলুল প্লানা

এরপর বিভিন্ন বন্ধুসভার বন্ধুদের ২০টির বেশি কবিতা, গান, নাচ আর কোরিওগ্রাফি মন্ত্রমুগ্ধের মতো উপভোগ করেন উপস্থিত বন্ধুরা। গোপালগঞ্জ বন্ধুসভার উপদেষ্টা কবি মিন্টু হকের স্বরচিত কবিতার মধ্য দিয়ে যার যাত্রা। একে একে ফরিদপুর বন্ধুসভার গামছা কাজল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেহনাজ বিনতে আমিন, নরসিংদী বন্ধুসভার অকৃত সাহা, রাজবাড়ী বন্ধুসভার কানিজ ফাতেমা ও নাজমুল হক সাবু, মাদারীপুর বন্ধুসভার বাঁধন খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার অর্পিতা রায় শাওন, ঢাকা মহানগরের অনিক সরকার ও হৃদয় দাসের গান যেন উন্মাতাল করে তোলে বন্ধুদের। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার সালমান ফারসির কবিতার সঙ্গে উম্মে হাবিবা ডায়নার নাচ; ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার রাফি ও সোনিয়ার দ্বৈত নাচ; উম্মে হাবিবা ডায়না, শারমিন সুর ও রাফির দলীয় নাচ; ড্যাফোডিল বন্ধুসভার ইমতিয়াজ ওমর ও মিমের দ্বৈত নাচ; ভৈরব বন্ধুসভার দলীয় নাচ সোৎসাহে উপভোগ করেন উপস্থিত সবাই। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ বন্ধুসভা ও কিশোরগঞ্জ বন্ধুসভার রিফাত ইসলামের মূকাভিনয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বন্ধুসভার রোদেল রহমানের ব্যান্ড আন্তনগরের পরিবেশনা সবাইকে মুগ্ধ করে। সব শেষে ড্যাফোডিল বন্ধুসভার বন্ধুদের চমৎকার র‌্যাম্প শোর মধ্য দিয়ে রাত নয়টায় ভাঙে মিলনমেলা। বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতল বাসে চড়ে একরাশ আনন্দ আর নানা গল্প জমিয়ে যাঁর যাঁর গন্তব্যে যাত্রা করেন বন্ধুরা।

পুরো সাংস্কৃতিক পর্বটি সঞ্চালনার গুরু দায়িত্ব পালন করেন জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের বইমেলা বিষয়ক সম্পাদক সাদিয়া রৌশনী সূচনা।

উৎসবে অংশগ্রহণকারী বন্ধুদের সাথে অতিথিরা।
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

উৎসব শেষে জাতীয় পর্ষদের সভাপতি উত্তম রায় তাঁর নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অল্প কথায় কিন্তু পূর্ণ ভালোবাসায় অংশগ্রহণকারী ও আয়োজনে সম্পৃক্ত সবাইকে যেভাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন, সেটিই যেন সবার মনের কথা। তিনি লিখেছেন, ‘দিন শেষে আমাদের গল্পগুলো প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির। অনেকেই প্রত্যাশার চেয়ে হয়তো বেশি নিয়ে গেছেন, অনেকেই প্রত্যাশামতো কিছু না পেয়ে দুঃখ নিয়ে গেছেন। আমাদের গল্পগুলো যেমনই হোক, দিন শেষে আমরা বন্ধু। যাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমে এই আয়োজন সফল হয়েছে, তাঁদের ভালোবাসায় পরবর্তী আয়োজনগুলো আরও সুন্দর ও মোহনীয় হয়ে উঠবে, এই আশায় সব সময় থাকব। বন্ধু উৎসবকে ঘিরে আমরা কিছু বন্ধু মিলে ছোট ছোট কিছু সুন্দর মুহূর্তের জন্ম দিয়েছি, এই স্মৃতিগুলো আমাদের বন্ধুত্বকে এগিয়ে নিতে দারুণ কাজে দেবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা টিম আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা, এত অল্প সময়ে এত সুন্দর আয়োজন করা যায়, আমি এই প্রথম দেখলাম। যাঁরা সার্বক্ষণিক এই সফলতার সঙ্গে ছিলেন, আপনারা আমাদের হৃদয়ে আছেন। কথা হবে বন্ধু।’

অনুষ্ঠান শেষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা টিমের সাথে বন্ধুসভার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।
ছবি: শাকিব হাসান

সব শেষে বলতে হয়, আবার দেখা হবে, কোনো এক উৎসবে কিংবা কোনো দুর্যোগে মানবিক সহায়তায়। দেখা হবে বন্ধুত্বে, সহমর্মিতায় কিংবা ভালোবাসায়। জয়তু বন্ধুসভা।

*সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ