রোববারের নায়ক আবদুর রহিম

একটি দোচালা ঘরে থাকেন আবদুর রহিম। ঘরে একটি নড়বড়ে খাট। সেটাই টেনে বের করা হচ্ছে। কেন? আরে ঘরে যে স্কুল হবে। ছাত্রছাত্রীরা বসবে কোথায়? মেঝেয় বিছানা পাতা হলো। রহিমের ঘর হয়ে গেল স্কুল। শিক্ষার্থী ৩ জন। রহিম গেল মায়ের কাছে। ‘মা, বই লাগবে।’ সন্তানের উৎসাহ দেখে মা তিনটি বই কিনে দিলেন। শুরু হয়ে গেল ক্লাস। আবদুর রহিমের ছাত্র কারা? পথের শিশুরা। শুরু তিনজন দিয়ে। আজ ৩৬ জন। স্কুলের নাম, মজার পাঠশালা। ক্লাস প্রতি শুক্রবার। সকাল ৮টায় শুরু। সাড়ে ১০টায় শেষ। তারপর নাশতা-পানি। দৌড়ঝাঁপ, গান-বাজনা, আবৃত্তি। শিক্ষার্থীরা রহিমকে স্যার বলে না। বলে মজার ভাইয়া। জানতে চাই কেন? রহিম হেসে বলেন, ‘আমার কথাবার্তায় ওরা বেশ মজা পায়। সে কারণে।’
আমাদের এই আবদুর রহিম পড়েন সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে। মাস্টার্স চূড়ান্ত বর্ষে। ক্লাস ফাইভ পাস মা গৃহিণী। অভাবের সংসার। ক্লাস থ্রি পাস বাবা অটোমোবাইল ওয়ার্কশপের শ্রমিক। চার মাস ধরে তিনি অসুস্থ। রোজগারহীন।
‘কেমন করে চলে, তোমার স্কুল?’ রহিম বলেন, ‘আমি টিউশানি করি। মাসে ছয় হাজার টাকা রোজগার হয়। আমার এই পুরো টাকা দিয়ে দিই মজার পাঠশালায়।’ আমি ঢাকা থেকে মোবাইলে পটপট করে নানা প্রশ্ন করছিলাম। ওর উত্তর শুনে আমার পটপটানি থেমে গেল। বলে কী ছেলে! বেশ কিছুক্ষণ পরে বলি, ‘তোমার কিছু ডোনেশন পেলে মনে হয় ভালো হয়?’ ‘নো ডোনেশন। আমি কোনো আর্থিক সাহায্য নেব না।’
আমি চুপ। চুপ করি থাকি। আবদুর রহিমের পাঠশালা সাতক্ষীরা শহরের পলাশপুরে। তাঁর কয়েকজন বন্ধুও তাঁকে সাহায্য করেন। শহরে আরও দুটো ঘটনা রহিম ঘটিয়ে ফেলেছেন। শহরের দুটি স্কুল তিনি বেছে নিয়েছেন। সেই স্কুলের দেয়ালে লিখেছেন, ‘মহানুভবতার দেওয়াল।’ তার নিচে আরও লেখা, ‘তোমার যা কিছুর প্রয়োজন নাই, তা এখানে রেখে যাও। আর যা তোমার প্রয়োজন, তা এখান থেকে নিয়ে যাও।’ এই অভিনব ঘটনা সাড়া ফেলেছে বেশ; বিশেষ করে স্কুলের ছেলেমেয়েরা এখানে রেখে যায় পুরোনো বই, পুরোনো খেলনা, ব্যাগ নানা কিছু। রহিম এখান থেকেই কিছু জিনিস সংগ্রহ করেন তাঁর ছাত্রদের জন্য।
কিন্তু জিনিসগুলো এমনি এমনি তিনি বাচ্চাদের দেন না। তাদের মধ্যে নানা রকম প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। বাচ্চারা যেন বুঝতে পারে জিনিসগুলো তারা অর্জন করেছে তাদের যোগ্যতায়। কত রকম ভাবনা তাঁর! সাতক্ষীরার সুন্দরবনে কী আছে? বাঘ, বাঘ। আমি বলব, আবদুর রহিম, আবদুর রহিম।
অনেক দিন সাতক্ষীরায় যাওয়া হয় না। এবার গেলে বাঘ নয় আবদুর রহিমকে দেখতে যাব। এর চেয়ে ভালো কিছু কি দেখার আছে!
লেখক: সভাপতি, প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ