মন ভরেছে মনপুরায়

রাজধানী ঢাকার বৃহস্পতিবারের যানজট সম্পর্কে কমবেশি সবারই নিশ্চয় ধারণা আছে। আমাদেরও ছিল। সেই ধারণাকে নিয়েই উবারে উঠেছিলাম। কিন্তু ধারণা যে চিন্তার সীমা অতিক্রম করবে, এটা বুঝিনি। সদরঘাটে আমাদের জন্য যে লঞ্চটাকে রশি বেঁধে অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে, সেটা বিকেল সাড়ে পাঁচটার পর অপেক্ষা করবে না। সে তার পথ ধরবে। কিন্তু রাস্তায় যানজটের যে অবস্থা, তাতে লঞ্চটাকে যদি প্রেমিকার মতো অপেক্ষা শেষে রাগ-অভিমান এমনকি মেজাজ গরম করার সময়ও দেওয়া হয়, তবু আমরা পৌঁছাতে পারব কি না সন্দেহ আছে। আমাদের ভোলার মনপুরাগামী পুরো দলটা এখন দুই ভাগে বিভক্ত। একদল এমভি ফারহান-৩–এ বসে আছে। আরেক দল রাজধানীর সদরঘাটগামী উবারের গাড়িতে।

মনপুরায় হরিণের কুঞ্জে। ছবি: অপূর্ণ রুবেল
মনপুরায় হরিণের কুঞ্জে। ছবি: অপূর্ণ রুবেল


অবশেষে হেঁটে, দৌড়ে ঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারলাম। আমরাও লঞ্চে পা রাখলাম, হুইসেল বেজে নড়ে উঠল এমভি ফারহান-৩।
পরিকল্পনাটা হুট করেই নেওয়া। দুই রাত আর এক দিনের জন্য রাজধানী ছাড়ব। ছুটব কোনো এক নিরিবিলি জায়গায়, যেখানে হাঁপ ছেড়ে নিশ্বাস নেওয়া যায়। স্থান নির্ধারণের পরে সময় বুঝে বৃহস্পতিবার ঠিক করা হয়। সেই ঠিক করা সময়েই আমাদের যাত্রা। আমরা বলতে, তাহমিনা তানি আপা, তাঁর স্বামী রাহাত ভাইয়া, তাঁদের দুই ছেলে ৯ বছরের তালহা, ৫ বছরের তাহিব, রাহাত ভাইয়ের বন্ধু, আমার প্রিয় সঙ্গী শারমিন রিমা, সুমি, তাসনিয়া, ইমরান ও আমার স্বামী অপূর্ণ রুবেল।

আমাদের গন্তব্য ভোলার মনপুরা দ্বীপ। যে লঞ্চটায় আমরা উঠলাম, তার বর্ণনা আগে একটু দেওয়া যাক। তিনতলা লঞ্চের ওপরের তলার বেশির ভাগটাই কেবিন। নিচের পুরোটাই ডেক। দোতলার সামনের দিকটা ফাঁকা। কারণ, এখানেই সারেংয়ের জায়গা। ফাঁকা না রাখলে বিশাল জলরাশি আর আগত লঞ্চের মধ্যে প্যাঁচ লেগে যাবে সম্ভবত।
সারেংয়ের পেছনের দুটি কেবিন আপাতত আমাদের দখলে। দলটাও বড়। তাই দুই কেবিন আর সামনের পুরো জায়গাটা আমাদের দখলে। তবে হইহুল্লোড় আমলে নিলে পুরো লঞ্চটাই আমাদের দখলে।

নদীতে নামল রাত
লঞ্চে সন্ধ্যা নামা দেখতে ভালো লাগে। চারপাশটা আস্তেধীরে অন্ধকারে ঢেকে যায়। অনেকটা সিনেমা হলের পর্দার মতো। ঝুপ করে রাত নামার আগেই জিরো পাওয়ারের বাল্বের মতো চাঁদ উঠে যায়। এটা চোখের জন্য বেশ আরামের।
চাঁদের আলোয় আমরা বসে থাকি লঞ্চের বারান্দায়। গল্প জমে। সঙ্গে ধোঁয়া ওঠা চা। বলে রাখা ভালো, লঞ্চে চা-কফি থেকে শুরু করে রাতের খাবার সবই পাওয়া যায়। বললে কেবিনেও পৌঁছে দিয়ে যায় কেবিন বয়। কিন্তু চা ছাড়া এই যাত্রায় আমাদের লঞ্চের খুব বেশি খাবার খেতে হয়নি। বাসা থেকে তাহমিনা আপু এনেছিলেন খিচুড়ি ও বেগুন ভাজি, রিমা এনেছিল সালাদ। আর সুমি গরুর মাংস। রাত ১০টার দিকে খিচুড়ি দিয়ে সেরে নিলাম রাতের খাবার। তারপর আবার আড্ডা। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে এ ভ্রমণ। তখনো ঢাকায় অতটা শীত পড়েনি। কিন্তু লঞ্চের মধ্যে মধ্যরাতে বেশ শীত। ভাগ্য ভালো যে শীতের পোশাক নিয়েছিলাম ব্যাগে।

মনপুরার রাস্তা। ছবি: অপূর্ণ রুবেল
মনপুরার রাস্তা। ছবি: অপূর্ণ রুবেল


আমাদের লঞ্চ ছুটে চলেছে মেঘনা নদী হয়ে। নদীতে ছোট ছোট মাছ ধরার নৌকা। প্রতিটি নৌকাতে আলো জ্বলছে। দূর থেকে মনে হয় নদীজুড়ে জোনাকি ঘুরে বেড়াচ্ছে। কী যে অপূর্ব সেই দৃশ্য, ভাষায় বোঝানো যাবে না। ওসব দেখতে দেখতে আর আড্ডায় ভোর হয়। মেঘনার জল ফুঁড়ে বের হয় আলো। সেই আলোতে চিকচিক করে চারপাশ। পরিষ্কার নীলচে আকাশ আমাদের অভিবাদন জানায়। এরই মধ্যে আমাদের লঞ্চ বেশ কয়েকটি ঘাটে ভিড়েছে। মনপুরা ঘাটে যখন থামে, তখন ভোর। দূর থেকে মনপুরা দ্বীপ দেখে আমরা চিৎকার করে উঠি। নামতে নামতে সূর্যের দিকে তাকাই। মনে হয়, মাত্র কাঁথা মুড়ি দেওয়া ওম ছেড়ে বেচারা আড়মোড়া ভাঙছে। ততক্ষণে আমাদের লঞ্চ মনপুরা ঘাটে ভেড়ে। আমরা নেমে যাই। এরপরের গন্তব্য হাজিরহাট। বাহন মোটরসাইকেল ও অটোরিকশা। 

হাজিরহাটে গিয়ে একটা হোটেল ঠিক করি। সারা দিনের জন্য দুটি রুম। একটা মেয়েদের, একটা ছেলেদের। দুই রুমের ভাড়া এক হাজার টাকা। সবাই একঝটকায় ফ্রেশ হয়ে নেয়। ততক্ষণে সবার পেটে সুচো ডাকছে। সকালের নাশতা সেরে নিই সাদা রুটি, ডাল, গরম পুরি আর মিষ্টি দিয়ে। সবকিছু ছাপিয়ে মিষ্টিটাই বেশি নম্বর পেয়ে যায়।

মনপুরার হাজিরহাট ভ্রমণ দল। ছবি: অপূর্ণ রুবেল
মনপুরার হাজিরহাট ভ্রমণ দল। ছবি: অপূর্ণ রুবেল


ইলিশ-হরিণের রাজ্যে
এরপরের গন্তব্য ইলিশের আড়ত। মনপুরা দ্বীপের ভেতরের রাস্তাগুলো বেশ সুন্দর। দুই পাশে গাছপালা। রাস্তার কোল ঘেঁষে পুকুর। মাটির একটা অদ্ভুত গন্ধ আটকে রাখে নিজেকে। লোকালয় পার হলেই নদী। মনপুরার চারপাশেই বিপুল জলরাশি। গাছপালা, খেত ডিঙিয়ে তাকালে চোখ আটকে যায় জলে।

ইলিশের আড়তে তখনো ভিড়। নৌকাভর্তি ইলিশ। যেগুলো গত রাতে আটকে পড়েছে জেলেদের জালে। নৌকা থেকে ইলিশের ঠাঁই হয়েছে নিলামকারীর দরবারে। সেখানে হালি হিসেবে হয় ডাক। সর্বোচ্চ দর ডাকা ব্যক্তিটি হয়ে যায় ইলিশের মালিক। নেই ইলিশ রাখা হয় বরফ দিয়ে। বিকেলের লঞ্চে সেগুলো ঢাকার পথ ধরে।

আড়ত, ইলিশ আর নদীর পাড় ঘিরে চলে আমাদের ফটোসেশন। তারপর সোজা হরিণের আশ্রয়স্থলে। এবার আমরা দুটি অটোরিকশা নিয়ে নিই। সরু পথ বেয়ে দুই পাশের ধানখেত, কখনো নদীর পাড় ঘেঁষে এগিয়ে যায় আমাদের রিকশা। কিন্তু সে যাত্রায় হরিণ দেখার সৌভাগ্য হয়নি। হরিণের পায়ের ছাপ দেখে, কাদাজল মেখে ফিরতে হয়েছে।

হরিণের বাসাবাড়ি দেখে খারাপ লাগেনি। এটা একটা কৃত্রিম বন। নদীর কোল ঘেঁষে গড়া। জায়গাটাও ছোটখাটো নয়। আমাদের একদল নেমে গিয়েছিল বনে। আরেক দল বসে ছিল। বসে থাকা দলের বিরক্তি দেখেই বোঝা গেছে সময় একেবারে কম লাগেনি।
বন থেকে ফিরে আমরা আবার হোটেলে উঠি। কেউ গোসল সেরে নেন। কেউ ফ্রেশ হন। তাজা ইলিশ ভাজিতে সারা হয় দুপুরের খাবার।  বেলা আড়াইটায় ফিরতি লঞ্চ। দ্রুত এসে উঠে পড়ি। এবারের বাহনও মোটরসাইকেল। লাল-নীল পতাকায় সজ্জিত নৌকাগুলো যেন আমাদের বিদায় দেওয়ার জন্যই অপেক্ষায় ছিল। পতপত করে উড়তে উড়তে বিদায় দেয় আমাদের। এক দিনের ঝটিকা সফর শেষে পরদিন ভোরে আমরা নামি ঢাকার সদরঘাটে।