প্রতীক্ষা

দুপুরের খাওয়া শেষ করেছি, শরীরটা ভার হয়ে এসেছে। একটা ঘুম দেব ভাবছিলাম, এমন সময় ডোরবেল বেজে উঠল। একরাশ বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলতেই, একটি মেয়ে মিষ্টি গলায় জিজ্ঞাসা করল, ভাইয়া সাদিয়া কি বাসায় আছে?
আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জিজ্ঞাসা করলাম, কোন সাদিয়া...
সাদিয়া মানে, আমার বন্ধু। আমরা একই সঙ্গে স্কুল পড়তাম। ওকে কি একটু ডেকে দেওয়া যাবে। আমি তখন অবাক হয়ে তাকে দেখছি আর ভাবছি। আমার ভাবনায় হুট করে সে বলে বসল, আপনি কি কিছু ভাবছেন? সংবিৎ ফিরে পেয়ে বললাম, না মানে আমি ভুল না করলে আপনি সুপ্তি সেন। বেশ ইন্টারেস্টিং তো, আপনাকে আমি চিনি না অথচ আপনি আমায় দেখেই আমার নাম বলে দিলেন। বাহ, আপনি তো অনেক ট্যালেন্ট। কেউ একজন যদি চিনিয়ে দেয় আর আমি যদি তা ভুল না করে বসি, তাহলে কি সেটাকে ট্যালেন্ট বলে কি না আমি জানি না। আপনি বোধ হয় সাদিয়ার কথা বলছেন, আই এম রাইট? আপনি একদম ঠিক ধরেছেন। আপনার সঙ্গে কথা বলেই চলেছি, সঙ্গে আমাকেও চিনে ফেলেছেন কিন্তু দেখেন আপনার বিষয় এখনো আমার অজ্ঞতা, কিছু মনে না করলে আমার অজ্ঞতা দূর করতে আপনার পরিচয়টা কী দেওয়া যাবে।
সত্যি আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।
মানে কি দেওয়া যাবে না...।
আমি সেটা বলিনি। আপনাকে দরজায় দাঁড় করিয়ে কথা বলছি সে জন্য, আপনি আসেন, ভেতরে আসেন।
আপনি বসেন আমি আসছি।
জি নিশ্চয়, আপনার পরিচয়?
সে না হয় এসেই দিই।
সাদিয়াকে আমার কথা বলবেন না। শুধু বলেন, কেউ একজন তার সঙ্গে দেখা করতে চান। আমি ওকে সারপ্রাইজ দিতে চাই।
আমি কিছু না বলে চলে গেলাম।
যখন চা হাতে রুমে এলাম, তখন দেখি তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে ড্রয়িং রুমে পশ্চিম দেয়ালে আটকানো সাদিয়ার সঙ্গে তার ছোটবেলার ছবিটা দেখছেন। আমি এসে সোফায় বসে বললাম, আপনার চা।
সুপ্তি সেন আবেগময় কণ্ঠে বলে বসলেন, সাদিয়া এই ছবিটা সংরক্ষণ করে রেখেছে? সত্যিই আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। ১২ বছর আগের ছবি কীভাবে সংরক্ষণ করেছে, বলেই বসে পড়লেন সুপ্তি সেন।
আপনার চা, আপনি নাকি দুধ–চা মোটেই পছন্দ করেন না। তাই আপনার পছন্দের লেবু–চা।
আপনি কিন্তু ক্রমান্বয়ে আমাকে অবাক করে দিয়েই চলেছেন।
তাই চায়ে চুমক দিয়ে তো বলবেন কেমন হয়েছে চা।
চায়ে চুমক দিয়েই বলে বসলেন, ১২ বছর আগে ফিরে গেছি। ইশ্ সেই দিনগুলো, জানেন, সাদিয়া একদিন আমার বাসা এসেছিল। বিকেলে আমরা দুজন জম্পেশ আড্ডা দিচ্ছি। আড্ডায় এত মগ্ন ছিলাম যে সন্ধ্যায় সাদিয়া বাসায় যাবে, ওর সঙ্গে আমিও ভুলে গেছি। এই নিমগ্নতা আমাদের কেটে গেল ল্যান্ড ফোনের আওয়াজে। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে আন্টি বলছে, সুপ্তি, সন্ধ্যা হয়ে গেছে, আকাশের অবস্থাও তেমন ভালো না, সাদিয়া এখনো বাসা আসছে না কেন?
জি আন্টি, এখনই বের হচ্ছে। ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দাও। জি আন্টি,
সাদিয়াসহ বের হচ্ছি, হঠাৎ মষুলধারে বৃষ্টি আরম্ভ হলো। সাদিয়া আর আমি ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম, কী করব! আম্মু বলছে, সাদিয়া, তোমার আম্মুকে ফোন দাও। আজ নাহয় তুমি থেকে যাও। সাদিয়া না বলে টেনশন করছে। হঠাৎ আবার সেই ল্যান্ড ফোনের আওয়াজ। ফোন ধরতেই আন্টি দুশ্চিন্তাময় ভয়েজ ভেসে আসছে। সুপ্তি, সাদিয়া কি বের হয়েছে, না এখনো তোমাদের বাসায় আছে। না মানে, আন্টি আছে এখনো, বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে তো। ঠিক আছে, সাদিয়াকে দাও তো ফোনটা। সাদিয়া টেনশনে হ্যালো বলেই, একটু স্বস্তি পেল মনে হয়। ফোন রেখে বলল, মা বলল এ অবস্থায় আসার দরকার নেই।
তোদের বাসায় থেকে যেতে, কথা শুনেই দুজনে আমরা যে কত খুশি হয়েছিলাম সেদিন। পরে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, সারা রাত আমরা জেগে কাটাব। এক ফ্লাস্ক লেবু–চা আর সঙ্গে মার্ক টোয়েনের লেখা বিখ্যাত উপন্যাস দ্য প্রিন্স অ্যান্ড দ্য পপার আর মাঝেমধ্যে একটু করে দুষ্টুমি। এভাবেই সেদিন আমাদের সারা রাত কেটে গেল।
বৃষ্টির রাতে আপনার গল্পের বই পড়তে ভালো লাগে, ঠিক বললাম তো?
বাহ, এটাও জানেন দেখছি। ভুলে গেছি, আপনার পরিচয় দেওয়ার কথা।
আপনি রাতে বাঁ কাঁধে ঘুমান, ডান কাঁধে ঘুমালে আজেবাজে স্বপ্নের কারণে ঘুমাতে পারেন না।
এই আপনি কে বলুন তো আমাকে, এত কনফিউশনে ফেলছেন কেন।
যদি বলি আপনার খুব কাছের একজন মানুষ।
সুপ্তি সেন চট করে দাঁড়িয়ে পড়লেন, আপনি কী বলতে চান? আর সাদিয়া কই?
পুরোনো অভ্যাস সহজে কি যায় বলেন, আপনি রেগে গেলে আপনার বাঁ চোখ আগের মতো এখনো কাঁপাকাঁপি করে। কুল, বসেন, আপনি রেগে গেলে কেউ একজন সুবির মামার চায়ের দোকানে লেবু–চা খাওতে নিয়ে যেত মনে আছে।
জি মনে আছে আমার, সাদিয়া কই সেটা বলুন।
আপনি একটু বসেন, সাদিয়া বের হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যে।
সরি, আচ্ছা ঠিক আছে। বলেই বসে পড়লেন সুপ্তি সেন।
যাই হোক, ভালো লাগছে যে আপনি শান্ত হচ্ছেন। আপনি রেগে গিয়ে শান্ত হলে এখনো দেখি আগের মতো ঘেমে যান।
আপনি কি আপনার পরিচয়টা দেবেন, প্লিজ!
নিশ্চয়ই, কেননা আমি বারবার সেটাই চেষ্টা করছি।
মানে বুঝলাম না...
আচ্ছা, আপনি যে দেয়ালে ছবিটা দেখছেন, সেটা কোন সময়ের তোলা মনে আছে আপনার?
মনে থাকবে না কেন। অবশই মনে আছে, ১২ বছর আগে পূজার দশমীর দিন। জানেন, যখন পূজা শুরু হতো, সাদিয়া আমার বাসায় গিয়ে থাকত আর আমরা যে কত রকমের মজা করতাম, আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না।
আচ্ছা, আপনার মনে আছে, সাদিয়ার নাড়ু ভীষণ পছন্দের ছিল। পূজা ছাড়াও আপনাদের বাসায় প্রায়ই নাড়ু খেতে যেত।
মনে থাকবে না কেন, দিনগুলো হয়তো এখন শুধু স্মৃতি। এরপরও দিনগুলো মনে পড়লে মন বারবার ছুটে যেতে চায় সেই শৈশবে। আচ্ছা, সাদিয়া আসছে না কেন এখনো।
সেটাই তো আমি বুঝতে পারছি না, আমি একটু কি ভেতরে দেখে আসব কেন আসছে না?
জি, নিশ্চয়, প্লিজ।
আমি যেতেই সুপ্তি বলে, এই যে শুনুন, ধন্যবাদ চায়ের জন্য।
মাথা দিয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিয়ে ভেতরে গেলাম। সাদিয়ার দেওয়া একটা চিঠি নিয়ে এসে সুপ্তিকে দিলাম।
অবাক হয়ে প্রশ্ন করে বসল সুপ্তি সেন। আমার চিঠি সাদিয়ার দেওয়া। ও আসছে না কেন, নাকি সে দেখা করতে চায় না।
জি, ঠিক ধারণা করেছেন, ছোটবেলার মতোই আপনার ধারণাটা এবারও ভুল। আপনি নাকি ছোটবেলায় যা যা ধারণা করতেন, তার পুরো উল্ট ঘটত।
হ্যাঁ, এটা ঠিক বলেছেন। জানেন, এখনো প্রায়ই এমনটাই ঘটে। আচ্ছা, আপনি কি এই ত্রিভুজের গোলকধাঁধা থেকে আমাকে মুক্তি দেবেন, প্লিজ...
বাহ, বেশ ভালো বলেছেন তো, আপনি, আমি ও সাদিয়া তিনটি রেখা, আর আমাদের ত্রিভুজ গোলকধাঁধা।
তা নয়তো কী, আপনি তো তা–ই করছেন। মেন্টালি প্রেসার দিচ্ছেন আমাকে।
ছোটবেলায় সাদিয়ার সঙ্গে আপনার শেষ ১৪ ফেব্রুয়ারির দিনটির কথা মনে আছে, যেদিন আপনি বলেছিলেন, গোলকধাঁধায় আপনি পড়তে চান না। এতে ভালোবাসা বিপর্যয় হতে পারে। এরপরও যখন সাদিয়া আপনাকে বারবার বোঝাতে চেষ্টা চালিয়েছিল, তখন আপনি বলেছিলেন, পড়াশোনা শেষ করি, বড় হই; তখন হয়তো নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে পারব।
সুপ্তি সেন একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললেন, জি মনে পড়েছে। সাদিয়ার কোনো এক কাজিন ছিল।
সেদিনের সেই ছেলেটি আমি ফয়সাল আহমেদ। সেদিনের মতো আমি আজও আপনাকে ভালোবাসি। সেদিন হয়তো বলতে পারিনি সামনাসামনি, কিন্তু আপনার স্মৃতি নিয়ে অপেক্ষা করে আছি। আপনার রেখে যাওয়া শৈশবের স্মৃতিতে আপনাকে খুঁজে পাই, হয়তো ভালোবাসি বলে তাই। আপনার ইচ্ছে, আপনি আমাকে জড়াতে পারেন, নিরাশ করতেও পারেন। এটা একান্ত আপনার নিজস্ব ব্যাপার। তবে পৃথিবীতে কেউ একজন যে আপনাকে নিভৃতে ভালোবাসে, সেটা তো জানলেন—এটাই আমার পরম পাওয়া।
আপনি চিঠিটা এখনই দেখতে পারেন।
সুপ্তি সেন চিঠি খুলেই দেখল—
‘আমাকে দেওয়া ১৪ ফেব্রুয়ারি কমেন্টমেন্টটা পারলে রাখিস। তুই কোনো একদিন আসবি বলে ছেলেটা নিজের বাড়ি ছেড়ে আমার বাড়িতে ওই যে পড়ে আছে আজও।
পারলে আমার শ্বশুরবাড়ি আসিস, তুই চাইলে ফয়সাল ভাই তোকে নিয়ে আসবে। ভালো থাকিস।’
চিঠি পড়ে ভেজা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, হয়তো আমি সেদিনের কথা মনে রাখতে পারিনি, তবে আজ থেকে আপনাকে আমার সারা জীবন মনে থাকবে। আমি সত্যি নিতান্তই দুঃখিত। আমার স্বামী, সংসার আর ছোট একটি মেয়েও আছে। সত্যিই আজ আমি অপারগ, ভালো থাকবেন। নিজের প্রতি খেয়াল রাখবেন। আমি...আসি...।