নৌকাবাইচে একদিন

আমাদের বাড়ির পেছনে দেওয়ান বাড়ি। বড় গৃহস্থ। ১৫–২০টা হালের বলদ। গরুর সঙ্গে গোটা চারেক ভেড়া। গরুর পাল নিয়ে যখন রাখালেরা মাঠে যেত, সেটা একটা দেখার দৃশ্যই হতো বটে। হালের বলদগুলোর ছিল লম্বা লম্বা শিং। আর এ ধরনের বাড়িতে থাকত একটা ‘পাগলা’ গরু। প্রতিবছর হতো ‘গরু দাবড়ানো’ উৎসব।

পাগলা গরুটাকে দিয়ে চাষ করা হতো না। সারা দিন সে শুয়ে–বসে কাটাত। সাধারণত তেজি ষাঁড়গরুকে পাগলা গরু বানানো হতো। প্রতিবছর নির্দিষ্ট একটি স্থানে গলার দড়ি বা রশি ছিঁড়তে হতো।
গরু দাবড়ানো দেখার জন্য কত অপেক্ষা ছিল আমাদের। দেওয়ান বাড়ি গমগম করে উঠত কয়েক দিন আগে থেকেই। স্পেশাল পাটের দড়ি বানানো হতো। বাড়ির বিবাহিত মেয়েরা দূর থেকে এ উপলক্ষে ‘নাইওর’ আসত। অনুষ্ঠানের দিন প্রায় ২০০ লোক খাওয়ানো হতো। অনুষ্ঠান হতো বকচর থেকে চার মাইল দূরে দেওতলা গ্রামে। ইছামতি নদীর পাড়ে।

পাগলা গরুটাকে ওই দিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত গলার দড়ি খুলে রাখা হতো। আশপাশের শস্যখেতে সে ঘুরে ঘুরে শস্য বা ঘাস খেত। দুপুরে তাকে ধরে আনা হতো বাড়িতে। তারপর বাঁধা হতো গোয়ালে। মাথায় শিংয়ে বাঁধা হতো লাল কাপড়। মাটির পাত্রে জ্বালানো হতো ধূপ। পাত্র থেকে উড়ত ঘন ধোঁয়া। সেই ধোঁয়ার পাত্র ধরা হতো পাগলা গরুর সামনে। গরুটা ডানে-বাঁয়ে মাথা বাঁকাতে থাকত।

ধূপ খেয়ে যেন তার আরও তেজ বাড়ে! আরও বলশালী হয়। পাগলামি যায় আরও বেড়ে। গলায় পরানো হতো কাগজের মালা। দুপুরে গরু ঝাঁপানোর (গরুর গোসল) পর তার শরীরে মাখানো হতো সরিষার তেল। সাড়া গা চিকচিক করে উঠত। 
এভাবে গরু দাবড়ানো চূড়ান্ত পর্বের দিকে এগিয়ে যেত। গরুর গলায় দুই দিকে বেঁধে দেওয়া হতো দুইটা রশি। একেক দিকের রশি থাকত ২৫–৩০ হাত। দুই দিকের সেই রশি ধরত ৫০–৬০ জন লোক। তারপর গরুটাকে বের করা হতো জয়ধ্বনি দিয়ে। গরুর মালিকের নাম উচ্চারণ করা হতো। মালিকের নাম ছিল আফাজদ্দিন দেওয়ান। দুই দিকে গ্রামের লোকজন দড়ি ধরে বলত—
‘আফা দেওয়ান কি জয়।’
এই বাক্য সবাই মিলে বারবার উচ্চারণ করত। 
গরু ছুটত নয়নশ্রী দেওতলার দিকে। তাকে দাবড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হতো নির্দিষ্ট মাঠে। গরু দাবড়ানোর মাঠে মস্তবড় একটা খুঁটি পুঁতে দেওয়া হতো। সেই খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হতো পাগলা গরুটাকে। তারপর তার পেছন থেকে শত শত লোকের চিৎকার শুরু হতো। অমনি গরুটা গলায় রশি ছিঁড়ে পালানোর চেষ্টা করত। যে মালিকের গরু যত তাড়াতাড়ি গলার রশি ছিঁড়তে পারত, তাদের জয়ী ঘোষণা করা হতো।

আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে হতো নৌকাবাইচ। আহ কতগুলো নৌকাবাইচ দেখার সুযোগ হতো আমাদের। বাইচ হতো কাউনিয়াকান্দি, বান্দুরা, গোল্লা, কলাকোপা, বারুয়াখালী, দাউদপুর কত জায়গায়। আমাদের এলাকায় বেশ কয়েক বাড়িতে ছিল বাইচের নৌকা। 
নৌকাবাইচের মৌসুম এলেই জেগে উঠত পাড়া। থইথই পানিতে হতো নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা। আমরা ছোটরা কখনো দূরের বাইচ দেখতে যেতে পারিনি। কত শখ হয়েছিল চন্দ্রখোলাতে যাব নৌকাবাইচ দেখতে। বড়রা যেত। আমাদের নিয়ে যেত কাছাকাছি কোথাও। দাউদপুর বা কাউনিয়াকান্দি।

বর্ষাকালে নদীগুলো থাকত স্বচ্ছ পানিতে টইটম্বুর। নদীর পানিতে মেলা বসে যেত যেন। নৌকায় নৌকায় নানা রকমের খাবার। বিক্রেতাদের হাঁকডাক। নিমকি, চানাচুর, বালুশাই, সন্দেশ কত রকমের খাবার নৌকায় নিয়ে বসেছে বিক্রেতারা। 
ময়ূরপঙ্খী নাও সাজানো হতো। এটা ছিল আমাদের বড় আকর্ষণ। ছেলেরা মেয়ে সাজত। নৌকার গলুইয়ের সামনে বসে থাকত রাধা। একটি ছেলে রাধা সাজত। আর একজন সাজত কৃষ্ণ। সে থাকত নৌকার হাল ধরে। তার কাছে থাকত বাঁশের বাঁশি। নৌকায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চলত গান। তুইতাল গ্রামের রঙ্গাদা (রঙ্গলাল সরকার) তিনি তাঁর গলায় ঝুলিয়ে নিতেন হারমোনিয়াম। গলা ছেড়ে গান গাইতে থাকতেন। তাঁর সঙ্গে দোহার ধরত কয়েকজন।


একটা বাইচে বেশ কয়েকটা ময়ূরপঙ্খী নাও দেখা যেত। বাইচের নৌকাগুলো ছিল বিশাল লম্বা। নৌকার পেছনে গলুইয়ের নিচে নৌকার মালিকের নাম লেখা থাকত। পাশাপাশি গ্রামের নামও লেখা হতো। 
যেমন:
আবদুল হালিম
সাং ঔরঙ্গবাদ
আমরা সেই নাম দেখে বুঝতাম মালিক কে। কোন গ্রাম থেকে এসেছে। বাইচ যখন শুরু হতো কী ছন্দোবদ্ধ মাঝিদের বৈঠা ফেলার তাল। বৈঠার নিচের অংশ থাকত লাল–নীল–হলুদ রং করা। প্রতিযোগিতা শুরুর পর সেকি উত্তেজনা ভাসমান দর্শকদের। নদীর দুই পাশে দুই নৌকা। মাঝিরা প্রাণপণে বৈঠা বাইছে। হাল ধরতেন ঝাঁকড়া চুলের বাবড়ি দোলানো কেউ। মাঝে একজন দাঁড়িয়ে টং টনানং টন এমন শব্দ করে কাঁসার ঘণ্টা বাজাত। সামনের গলুইয়ে দাঁড়াতেন লম্বামতো একজন। তারও থাকত কোঁকড়া চুল। দুই হাতে বৈঠা দিয়ে নানা ভঙ্গিতে মাথার ওপর সেটা ঘোরাতেন। তার শরীরও নাচাতেন। এ রকম পারফরমেন্স দেখে আমরা মুগ্ধ হতাম। ইচ্ছে হতো বড় হয়ে একদিন আমিও ওই রকম হব।


বর্ষা মৌসুম। বাড়িতে আয়োজন চলছে। আমরা নৌকাবাইচ দেখতে যাব দাউদপুরে। আমাদের বাড়িতে তখন কাজ করতেন ইউনুস। আমরা তাঁকে ইউনুস ভাই বলতাম। আমাদের বিলেতি গাবগাছের নিচে দাঁড়িয়ে দেখছি, ইউনুস ভাই নৌকা পরিষ্কার করছেন। নারকেলের ছোবড়া দিয়ে তিনি নৌকার পাটাতন, গলুই সব ঘষে ঘষে পরিষ্কার করতেন।

বাড়ির সামনে বর্ষার পানিতে বড়রা সাঁতরিয়ে গোসল করল। দুপুরের ভাত খেয়ে আমরা রওনা দিলাম। আমাদের বড় নৌকাতে বিছানো হয়েছিল সতরঞ্জি। আমরা ভাইবোন, চাচাতো বোনেরাও ছিল। নৌকা চলল দাউদপুরের দিকে। 
বাইচ শুরু হয়ে গেল। চরম উত্তেজনা। সবার চোখ বাইচের নৌকার দিকে। ঠিক সেই সময় নাজু আপু নাক বন্ধ করলেন। ‘উঁহ কি গন্ধ। গুয়ের গন্ধ মনে অয়ং।’

দাদাও নাক চাপলেন। ‘তাই তো। কই থাইকা গন্ধ আসতেছে।’ আমাদের ছোটদের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘অ্যাই, তোরা কেউ আকাম করছ নাই তো?’ দাদা আমাকে টার্গেট করলেন। আমার পাছায় হাত রাখলেন। 
‘কাম সারছে। ভাইয়ে তো কাপড় নষ্ট কইরা ফেলছে।’ আমার এই দুরবস্থায় বড়দের সে কী হাসি। দাদা আমাকে দুই হাত ধরে নদীর পানিতে কোমর পর্যন্ত চুবিয়ে ধরলেন। ধুয়ে পরিষ্কার করলেন। 
কেউ একজন এই দৃশ্য দেখে বললেন, ‘চাচা মিয়া, খুব ভালো অইছে। ঘাউরা মাছে আপনার নাতির ওইগুলা খাইতে পারব।’

লজ্জায় আমার অবস্থা কাহিল। তখন আমার পাঁচ কি দশ বছর বয়স। দাদা ইউনুস ভাইয়ের লাল গামছা আমাকে লুঙ্গির মতো পরিয়ে দিলেন। 
আমাদের বাড়ির পাশে ছিল দুটো জোড়া তালগাছ। বর্ষায় তাল পাকত। আর ধপপাস ধপপাস করে তাল পড়ত পানিতে। তালের কথা উঠতেই তালের পিঠার কথা মনে পড়ল। দূর অতীত থেকে ভেসে আসছে সেই পিঠার ঘ্রাণ। তাল, চিতই, ফুলান দেছা কত রকমের পিঠা ছিল।

একদিন ভোরবেলা চোখ না মেলতেই কানে শব্দ এল। কিছু একটা ছটফট করছে। আমাদের কেবিন ঘর থেকে বের হয়ে উঠোনে গিয়ে দেখি বড় বড় চিংড়ি মাছ। সঙ্গে অন্য মাছও আছে।
বড় ভাই আনজুম দোআইর (বাঁশের তৈরি মাছ ধরার খাঁচা) পাততেন। সেই খাঁচাগুলো সন্ধ্যাবেলায় ধানখেতের আশপাশে পানির নিচে পেতে রাখতেন। খাঁচাটার মুখটা ছিল এমন যেটা দিয়ে মাছ একবার ঢুকলে আর বের হতে পারত না। সকালবেলা তিনি সেই দোআইর ওপরে টেনে তুলতেন। সেটাতে ছটফট করে উঠত মাছ। দোআইরে মাছের এক ধরনের খাবারও দেওয়া হতো।