টিভি নাটক


মানুষের প্রতিনিয়ত যে জীবনাচার্য, সেলুলয়েডের বদৌলতে তা পর্দায় এসেছে; মানুষ নিজের চলচ্ছবির প্রকাশসন্ধান পেয়েছে। বিজ্ঞানের অভাবনীয় সাফল্যের কারণে সারা দুনিয়া আজ ক্যামেরাবন্দী। টেলিভিশন নাটক তেমনই একটি পর্ব, যা নির্মাণ কারিগরের শিল্পছোঁয়ায় হয়ে ওঠে অনিন্দ্য সুন্দর। টেলিভিশন নাটক নির্মাণ নিয়ে যদি কেউ ভাবতে চান, কিংবা ভাবেন—হোক সে ভাবনা নাট্যরচনা-পরিচালনা-প্রযোজনা অথবা অভিনয়কেন্দ্রিক—তাঁকে হতে হবে চৌকস। জানতে হবে খুঁটিনাটি বিষয়-আশয়। তাঁদের জন্য অন্তত প্রাথমিক ধারণা নিতে এখানে একটি নমুনা টেলিভিশন নাটকের স্ক্রিপ্ট তুলে ধরা হলো। বলা প্রয়োজন যে স্ক্রিপ্ট লেখার ধরন বা কৌশল লেখক ভেদে ভিন্নতর হয়। মোটামুটি যে নমুনা স্ক্রিপ্ট দেখলে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়, তেমন একটি স্ক্রিপ্ট তুলে ধরা হলো। স্ক্রিপ্টটি এনটিভিতে এক ঘণ্টার নাটক হিসেবে প্রচারিত হয়েছে। ইউটিউবে বাংলা নাটক ফোনকল লিখলেই খুঁজে পাওয়া যায়। চাইলে কেউ পড়া স্ক্রিপ্টের সঙ্গে নির্মিত নাটকটিও দেখে নিতে পারেন।

নাটক
ফোনকল

যাঁরা নাটক লিখতে আগ্রহী। নাটকের উদাহরণ হিসেবে নিচে কয়েকটি দৃশ্যে তুলে ধরা হলো।

দৃশ্য: ১
দিন: বাসাবাড়ি
চরিত্র: নন্দিতা, পথচারী
জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে নন্দিতা, গুনগুন করে একটা গান গাইছে সে। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে একজন যুবক তাকিয়ে আছে নন্দিতার বাড়ির দিকে। একবার যুবকটি হাত নেড়ে নন্দিতার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নন্দিতা বিষয়টি প্রথমে বুঝতে পারে না, পরে বুঝতে পেরে কিছুটা অবাক হয়। একসময় জানালা থেকে সরে যেতে থাকলে যুবকটি ইশারায় নন্দিতাকে ডাকতে ডাকতে রাস্তা পার হতে থাকলে রাস্তায় একটা গাড়ি তাকে ধাক্কা দিয়ে যায়। রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে যায় রাস্তায়। নন্দিতা তা দেখে চিৎকার করে ওঠে। এক দৌড়ে জানালার কাছ থেকে সরে বিছানার দিকে যায়।

(কাট)

দৃশ্য: ২
দিন: বাসাবাড়ি
চরিত্র: নন্দিতা, দীপন (কণ্ঠ), অপরিচিত (কণ্ঠ)
জানালা থেকে ছুটে সরে এসে বিছানায় বসে ভয়ে হাঁপাতে থাকে। নন্দিতার চোখেমুখে চরম ভয়ের ছাপ ফুটে ওঠে। একপর্যায়ে সে বিছানায় পড়ে থাকা মোবাইলটি হাতে নেয় এবং অস্থিরভাবে দীপনকে ফোন করে। দীপন কয়েকবার ফোনটি কেটে দেয়। নন্দিতা বেশ কয়েকবার ফোন দিতেই থাকলে ফোন রিসিভ করে সে। দ্রুততার সঙ্গে কথা বলতে থাকে নন্দিতা। তার হাত–পা কাঁপতে থাকে।
নন্দিতা: শোনো আমাদের বাসার সামনের রাস্তায় একটা ছেলে কিছুক্ষণ আগে গাড়িচাপা (কথা শেষ করতে পারে না)
দীপন (কণ্ঠ): আমি ব্যস্ত আছি পরে কথা বলি (ফোন কেটে দেয়)।
নন্দিতা আবার কয়েকবার দীপনকে ফোন দেয়, দীপন ফোন রিসিভ করে না। একপর্যায়ে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বিছানার কোনায় বসে পড়ে এবং কাঁপতে থাকে। কিছুক্ষণ পর নন্দিতার ফোন বেজে ওঠে। দীপনের ফোন মনে করে দ্রুত ফোন রিসিভ করে কথা বলা শুরু করে নন্দিতা।
নন্দিতা: শোনো না, আমাদের বাসার সামনের রাস্তায় একটা ছেলে কিছুক্ষণ আগে গাড়িচাপা পড়েছে...
অপরিচিত (কণ্ঠ): এ আর ঢাকা শহরে নতুন কী? ঢাকা শহরে রোজই কোথাও না কোথাও কেউ গাড়িচাপায় মরছেই, রোজই মরছে আর আমরা রোজই দেখছি...
নন্দিতা: আরে তা না, ছেলেটা আমাকেই কী যেন বলতে বলতে রাস্তা পার হচ্ছিল আর ঠিক সেই সময় গাড়িটা এসে চাপা দিয়ে গেল...
অপরিচিত (কণ্ঠ): আপনাকে কিছু বলতে চাচ্ছিল? আপনি শিওর?
নন্দিতা: হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি শিওর। ছেলেটাকে আগেও একবার ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম, কিন্তু তখন কিছু মনে হয়নি।
অপরিচিত (কণ্ঠ): আরও একবার দেখেছিলেন? কোথায়?
নন্দিতা: আরে ওখানেই, যেখানে সে একটু আগে দাঁড়িয়ে ছিল, তখন আমি ভেবেছিলাম কে না কে, হয়তো অন্য কারও জন্য দাঁড়িয়ে আছে...
অপরিচিত (কণ্ঠ): আপনার পুরোনো বয়ফ্রেন্ড নয় তো?
নন্দিতা: আরে আমার বয়ফ্রেন্ড হবে কেন ? কী যে বলো না...
(নন্দিতার হঠাৎ খেয়াল হয়, সে কার সঙ্গে কথা বলছে? ফোন কান থেকে নামিয়ে নম্বর দেখে)
নন্দিতা: এই কে আপনি?
অপরিচিত (কণ্ঠ): তুমিই তো ভালো লাগছিল, আবার আপনি ধরলেন কেন?
নন্দিতা ফোন কেটে দেয়। আরও ভয় পায়। ফোনটা দূরে ছুড়ে মারে। ফোনটা ছুড়ে মারার পর আরও কয়েকবার ফোন বেজে ওঠে, নন্দিতা ফোন রিসিভ করে না, ভয়ভয়ভাবে ফোনের দিকে চেয়ে থাকে।

(কাট)


দৃশ্য: ৩
দিন: বাসাবাড়ি
চরিত্র: নন্দিতা
দরজায় কলবেল বাজার শব্দ হতে থাকে। বিছানায় মুখ গুঁজে বসে থাকা নন্দিতা প্রথমে তা খেয়াল করে না। একসময় খেয়াল করে, হন্তদন্ত হয়ে বিছানা থেকে নেমে গিয়ে দরজা খোলে। কিন্তু দরজা খুলে কাউকে দেখতে পায় না, এমনকি দরজার নিচে পড়ে থাকা পেপার বিলটাও লক্ষ করে না সে। ফলে আরও ভয় পায় এবং দরজা বন্ধ করে দেয়। ভেড়ানো দরজায় গা লাগিয়ে বসে পড়ে। ক্যামেরা ধীরে ধীরে দেয়ালে টাঙানো ঘড়িটাকে কভার করে। ঘড়িতে বেলা দুইটা বাজে। ক্যামেরা নন্দিতার অস্তিরতার কয়েকটি দৃশ্য ধারণ করে। নন্দিতা কখনো মেঝেতে, আবার কখনো বিছানায় বসছে, কখনো পায়চারি করছে, কখনো মোবাইল ফোন ঘাঁটছে। কখনো মোবাইল বেজে উঠছে, কিন্তু অপরিচিত নম্বর দেখে রিসিভ করছে না। কখনো ফ্লাশব্যাকে চলে যায়। কখনো জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে দেখতে চাইলেও সেদিকটায় তাকানোর সাহস পাচ্ছে না। নন্দিতার এই অস্থিরতার সঙ্গে যোগ হয় দেয়াল ঘড়ির টিক টিক শব্দ। ঘড়িতে পর্যায়ক্রমে চারটা, ছয়টা ও নয়টা বাজে।

(কাট)


দৃশ্য: ৪ (ফ্লাশব্যাক )
রাত: বাসাবাড়ি
চরিত্র: নন্দিতা ও দীপন
মাত্র অফিস থেকে ফিরেছে দীপন। বাড়ীর মধ্যে ছোটখাটো একটা ঝগড়া চলছে।
দীপন: তোমার কী ধারণা? আমি ইচ্ছাকৃতভাবে তোমার সঙ্গে কথা বলি না! অফিসে একটা মিনিট অবসর পেলেই আমি সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা হাতে নিয়ে তোমাকে ফোন করি। আমার কখনো মনে পড়ে না যে আমি একটা মিনিট ফাঁকা পেয়েছি আর তোমাকে ফোন করিনি, তোমার সঙ্গে কথা বলিনি।
নন্দিতা: হ্যাঁ, ফোন করে খুব কথা বলো। খাইছি কি না, ঘুমাইছি কি না, কী করছি এই তো?
দীপন: আচ্ছা আমি তো একটা অফিসে চাকরি করি নাকি? আমি চাইলেই তোমার সঙ্গে অফিস পিরিয়ডে ১০ মিনিট–আধা ঘণ্টা কথা বলতে পারি না। তোমার কী ধারণা, আমার তোমার সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলতে ইচ্ছা করে না?
নন্দিতা: না করে না।
দীপন: এটা যদি তোমার আমার প্রতি বিশ্বাস হয়, তাহলে আমার কিছু বলার নেই।
নন্দিতা: আমি কী করব বলো, তুমি সারা দিন অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকো, কিন্তু আমি কী করি? আমার অনেক খারাপ লাগে, সময় কাটতে চায় না।
দীপন: তোমার এই খারাপ লাগা যে আমি বুঝি না, তা কিন্তু না; বরং তোমার এই একাকিত্ব তোমাকে যতটা খারাপ লাগায়, আমাকে তার চেয়েও বেশি খারাপ লাগায়। কিন্তু বুঝে কী করব বলো? আমার কী করার আছে? তুমি আমাকে বলো যে আমার এইটা করার আছে! আমি সেটাই করব।
নন্দিতা: আমি কিছু জানি না।

(কাট)