চাকু কাহিনি


আমার পাশেই একটি মৃতদেহ।
চারপাশ নিস্তব্ধ, রাত হয়তো বেশ গভীর। লোকটিকে আমিই হত্যা করেছি। তাই আপাতত ভয় পাওয়ার কোনো প্রশ্নই উঠছে না।
ধারালো চাকু ব্যাগে নিয়েই ঘুরি। আজ কাজে লাগালাম। কাঁচা হাতে কেঁপে উঠে শিউরে দিয়েছিল আমার গোটা শরীর। তবু অন্ধকারেই গলা বরাবর বসানোতে গলার সামনের অংশটা ঝুলে আছে।
রাতের এ ঘটনা শোনার পর সমাজের মানুষের চোখের বাঁকা দৃষ্টি আর শব্দের বোমা আমায় তিল তিল করে মারবে।
কিছু না ভেবেই আমার পেট বরাবর বসিয়ে দিলাম চাকু।
আমি একটা গ্রামের মেয়ে। ঢাকা শহরটি নাকি টাকার শহর। তাই বাবা–মা জোর করে ঢাকার শহরে নিজের মেয়েকে টাকার জন্য যেন পারলে বিক্রি করেই দিতেন। চাকরি নিলাম গার্মেন্টসে। এক মাস এই শহরে থাকার মধ্যেই এক রাতে বাসায় ফেরার পথে নরখাদকের হাতে পড়লাম। এরপর সেই অন্ধকার রাত।
চাকুটা নিজ পেট বরাবর বসানোর পর জ্ঞানহীন অবস্থায় পড়েছিলাম।
এখন হসপিটালের কেবিনে আছি। কে কীভাবে এখানে বাঁচিয়ে এনেছে জানা নেই।
কোনোমতে সংবাদমাধ্যমকে ফাঁকি দিয়ে সপ্তাখানেক পর নিজ গ্রামের বাড়ি ফিরলাম আভিজাত্যের সঙ্গে।
মা আমায় দেখেই দৌড়ে এসে মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘ট্যাকা আনছোস?’
আমি অবাক হইনি, নতুন কিছু না। আমি মাকে হাসিমুখে একটা জামদানি শাড়ি আর বাবার জন্য আনা নতুন একটা মোবাইল ফোন মায়ের হাতে দিয়ে বললাম, ‘আগের ফোনটা তো ভেঙে গেছে।’
গার্মেন্টসে কাজ করা মাসখানেকের মধ্যে এত টাকা কীভাবে পেল, তা নিয়ে মায়ের চোখেমুখে প্রশ্ন।
আমি বললাম, ঘরে চলো বসে বলি।
কিছুক্ষণ পর বাবা বাড়ি এলে তাদের হাতে দুই লাখ টাকা তুলে দিয়ে মিষ্টির প্যাকেট থেকে মিষ্টি বের করে বললাম, টাকা চেয়েছিলে, এনেছি তো, এবার নাও মিষ্টিটাও খাও।
তাদের টাকার প্রতি লালসা আর টাকা আয়ের সন্ধান কীভাবে দুটির আকর্ষণই এখন তীব্র।
আমি বলতে লাগলাম,
‘যে মেয়েকে টাকার লোভে ঢাকা পাঠিয়েছিলে, সে দিনের শহরটা কোনোভাবে চিনলেও রাতের শহরটা একেবারেই অচেনা ছিল। তার সুযোগ লুফে নিয়েছিল এক ধনাঢ্য বাবার ছেলে।
হাসপাতালে নেওয়ায় ছেলেটি সে রাতে বেঁচে যায় আমার চাকু ডাবানো সত্ত্বেও। তবে তার বাবা–মার ভয় যদি সংবাদটি ছড়িয়ে যায় তবে যে তাদের সম্মান থাকবে না। এবার সুযোগ লুফে নিলাম আমি। মুখ বন্ধ রাখার বিনিময়ে প্রায় আড়াই লাখ টাকা পেলাম।
তোমাদের মেয়ের শরীরের বিনিময়ের টাকার শাড়ি পরে সেই টাকার মিষ্টিটাই খাচ্ছ এখন, মা।
তাদের চোখে পানি, যা মোটেও আমার প্রতি কোনো ভালোবাসার পানি হতে পারে না।
রাতে তাদের সঙ্গে আর কোনো কথা বলা হলো না। আমি বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে।
সবাই ঘুমিয়ে। পেছনে হঠাৎ তাকিয়ে দেখি সুমন চাচার ছেলে সোহরাব ভাই। একমাত্র সম্বল চিৎকারটা করার আগেই ঝাপটে ধরল। সব সময়ই হয়তো চাকুটা আনায় বাঁচাতে পাশে থাকবে না। সেই রাতে আর রেহাই পেল না, পচে গেল শরীরটা।

টাঙ্গাইল বন্ধুসভা