একাত্তরের দিনগুলি: জাহানারা ইমাম

১৯৭১ সালের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ববর্তী সময়, যুদ্ধকালীন ও স্বাধীন বাংলাদেশ হওয়ার সময়টুকু সুন্দর করে উপস্থাপন করা হয়েছে এই বইয়ের মাধ্যমে। এই লেখাগুলো একজনের লেখা হলেও এর মাধ্যমে পুরো বাংলাদেশের তৎকালীন অনেক চিত্র ফুটে উঠেছে।

লেখিকা জাহানার ঈমাম তার নিজের কথাগুলো লেখার মাধ্যমে ওই সময়কার দিনগুলোর বর্ণনা করেছেন। যুদ্ধের প্রতিটি দিনই যে লোমহর্ষক ছিল, তা এই বইয়ের লেখাগুলো পড়লেই বোঝা যায়।

এ বইটি শুধু বই না, এটি তখনকার যুদ্ধের সময়কার দিনগুলোর জ্বলন্ত বিবরণের দলিল। যা পড়লে আমরা বুঝতে পারি কতটা ভয়াবহ কঠিন সময় কাটিয়েছিল তখনকার বাঙালিরা। নিজ দেশে থেকে অন্যায় না করেও অত্যাচারিত হতে হয়েছিল লাখ লাখ মানুষকে। মুহুর্তেই বিনাকারণে মৃত্যুের কোলে ঢলে পড়েছে নিষ্পাপ অনেক প্রাণ। অনেকে প্রাণে বেঁচে গেলেও গুরুতর আহত হয়ে জীবন পার করতে হয়েছে আমরণ।

ঢাকাসহ সারাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি যুদ্ধের সময় কেমন ছিল, দোকানপাট, মার্কেট, পাড়া-মহল্লা, স্কুল- কলেজ, অফিস - আদালত ইত্যাদি কেমন করে চলেছিল, রাস্তায় বাঙালিদের কেমন করে অকারণে হেনস্তা করেছে মিলিটারিরা, জিনিসপত্রের চাহিদা, দাম কেমন ছিল, পণ্য সরবরাহ কেমন ছিল ইত্যাদি বিভিন্ন দিক এসেছে এই বইয়ে।
লেখিকার বড় ছেলে রুমীসহ ছোট ছেলে জামী, স্বামী শরীফ ইমাম ও অন্যান্যদের হঠাৎ আগস্টের এক রাতে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরে অনেক অত্যাচার করে রুমীকে রেখে বাকিদের ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল মিলিটারিরা। কিন্তু রুমী তার মায়ের কোলে আর কোন দিন ফিরে আসেনি। অত্যাচারের বর্ণনা শুনলে শিউরে উঠতো, এতই নোংরা ও কঠিন ছিল অত্যাচার।

বিভিন্ন সময় মার্কেটে গিয়ে অল্প অল্প করে ঔষধ, কাপড়, খাবারসহ প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র কিনে এনে বাসায় রেখে ছোট ছোট প্যাকেট করে রাখতেন লেখিকা। যাতে হঠাৎ কেউ আসলে মুক্তিযুদ্ধাদের ক্যাম্পে পাঠানো যায়।
বিভিন্ন সময় হঠাৎ করে কারফিউ দেওয়ার ফলে জীবনযাত্রায় যে অসুবিধা হয়েছে, তার অনেক বর্ণনা এসেছে এখানে। কেউ হয়তো বাজার করতে বের হয়েছে বা কেউ অফিসে বা দোকানে, সবাই তখন তাড়াহুড়ো করে দৌড়ে ছুটে যেতো বাড়িতে।
লেখিকাও বাজার সদাই বেশি বেশি করে বাড়িতে রেখে দিতো। এছাড়াও বেশি খাবার রান্না করে ফ্রিজে রেখে দিত। যাতে করে হঠাৎ করেই কোন আত্নীয় বা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে এমন কেউ এলে তাকে যেন খাবার খেতে দিতে পারে।

খালেদ মোশারফের মত নেতার কথাও এখানে উল্লেখ্য করা হয়েছে। যাকে তখনকার সময়ে যুদ্ধারা আদর্শ হিসেবে মানত। খন্ড খন্ড বিভিন্ন গেরিলা যুদ্ধগুলো তখন মিলিটারিদের রাতের ঘুম হারাম করে দিতে। লেখিকার লেখার মাধ্যমে সেসব গেরিলা
বাহিনীর কিছু যুদ্ধের বিবরণ এখানে পাওয়া যায়। যা দেখে ও শুনে তখন সত্যিকারের বাঙালিরা খুশি হতেন। এরকম সাহসী একটা গেরিলা যুদ্ধ করার কয়েকদিন পরেই লেখিকার বড় ছেলে রুমী আটক হয়।

এখানে শহীদ আজাদের কথাও আছে। আজাদের মা স্বামীর নতুন বিয়ের কারণে কষ্ট পেয়ে বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে একমাত্র ছেলেকে নিয়ে চলে আসেন ভাড়া করা ছোট্ট কুটিরে। মা ও ছেলের জীবন মোটামুটি ভালই চলছিল। মায়ের অনুমতি নিয়েই আজাদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন পাক- হানাদার বাহিনী তাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তার মা রমনা থানার একজনকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে দুদিন দেখাও করেছিলেন থানার পিছনের জানালা দিয়ে। তারপর আর খোঁজ নেই আজাদের।

পাগলাপীরের বাড়িতে তখন সবাই আসতো তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া স্বামী, সন্তান, বাবা ও আত্মীয়- স্বজনের খোঁজ নিতে। পাগলাপীর বাবা যদিও সবসময় সবাইকে এই বলে সাত্বনা দিতেন যে, ভাল আছে, ফিরে আসবে, চিন্তা করিস না। কিন্তু আসলে সেরকম কিছু হতো না। তবুও মানুষ প্রতিদিনই ফিরে আসার আশা নিয়ে সেখানে গিয়ে ভীড় করতো। অনোক তার জন্য্ মিষ্টি সিগারেট নিয়ে দিতো। লেখিকাও তার ছেলের জন্য অনেকদিন এই পাগলাপীর বাবার বাড়িতে যেতেন। কিন্তু তার ছেলে রুমী আর ফিরে আসেনি।

যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে রাজাকার বাহিনী, শান্তি কমিটির সদস্যরা, আল-সামস্, বিহারীসহ বিভিন্ন নিজের দেশের শত্রুরা যে কেমন ব্যবহার করেছিল এবং যুদ্ধাদের ধরিয়ে দিতে সাহায্য করতেন, সে বর্ণনাও পাওয়া যায় এই বইয়ে।

ডিসেম্বরের দিকে ভয়াবহ দিন গেছে। ভারত যখন পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশকে সমর্থন করছে, তখন ঢাকাসহ সারাদেশে যুদ্ধ চলছে। অবশ্য ভারত না পাকিস্তান যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, তা নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল তখন।

আকাশে তখন প্রতিনিয়ত বিমান চলতে। আর তা দেখার জন্য অনেকেই ঘর থেকে বের হয়ে রাস্তায় যেতো ও ছাদে উঠতো। তখন বোমা ফালানোর ফলে অনেকেই আহত ও নিহত হতো। এ কারণে শেষের দিকে দেখা গেল লেখিকার বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন ও পাড়াপড়শি মিলে প্রায় ৪৫ জনও থেকেছেন। স্বামী ও ছেলে হারানোর কষ্ট নিয়েও লেখিকা তখন এসব ম্যানেজ করেছে। ভাবতে অবাক লাগে তিনি কত কঠিন মানুষ ছিলেন! ঘরে অসুস্থ শ্বশুর, সদ্য স্বামীর মৃত্যু, রুমীকে না পাওয়ার আশা, জামীর যুদ্ধে যাওয়ার প্রবল আগ্রহ ইত্যাদি সবকিছু সত্ত্বেও তিনি শান্তভাবে সবকিছু সামাল দিয়েছেন।