আব্বার বিয়ে

আব্বা চাকরি করতেন ক্যালকাটা সুইমিং ক্লাবে। তাঁর বিয়ে শাদির কথা চলছে পাশের গ্রাম সুজাপুরে। উচ্চবংশ। মেয়ে সুন্দর। হা। হা। আমার মা। আজিমা খাতুন। মেয়ের আত্মীয়-স্বজনও চাকরি করতেন কলকাতায়। ছেলের আদ্যপ্রান্ত এবং পরিবার সম্পর্কে জানার পর তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, এই ছেলের সঙ্গে বিয়ে না হওয়াই ভালো। তারা চিঠি লিখলেন কোলকাতায়। গ্রামের পথে সেই চিঠি নিয়ে যাচ্ছিল একটি ছেলে। দাউদপুর পোস্ট অফিসে চিঠিটা ছাড়বে। আমার দাদা মনির উদ্দিনও যাচ্ছিলেন সেই পথে সেই সময়। দাদা ছেলেটাকে দেখে চিনে ফেললেন। দেখলেন ছেলেটার হাতে একটা ইনভেলাপ-চিঠি। দাদা নিশ্চিত, চিঠি যাচ্ছে কলকাতায়। বিয়েশাদির ব্যাপার নিয়েই...!

দাদা জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই খোকা কোথায় যাচ্ছো?’
‘পোস্ট অফিসে।’
দাদা কোমল স্বরে বললেন, ‘বাপরে বাপ। একটা চিঠি ছাড়ার জন্য এত দূরে যাচ্ছো। আমি তো বাজারেই যাচ্ছি। চিঠিটা আমার হাতে দিয়ে দাও। চিঠিটা আমি ডাকবাক্সে ফেলে দেব। তুমি বরং খেলতে যাও।’
সত্যি সত্যি চিঠিটা দাদার হাতে দিয়ে ছেলেটা চলে গেল। ভাতের আঠায় লাগানো চিঠিটা। দাদা সহজেই চিঠি খুলে ফেললেন। অতপর পাঠ করলেন।
চিঠি পড়ে দাদা অবাক। হায়, হায়, সর্বনাশ। একি লিখেছে তারা।

চিঠির বার্তা এরকম—
পর সমাচার এই যে, বকচর নিবাসী মনিরুদ্দিন আহমদের ছেলে আবদুল ওহাবের সঙ্গে আমাদের আজিমার (পুটি) বিবাহ হইতে পারে না। তাহারা গৃহস্থ। জমি চাষ করে। আর আমাদের পরিবার উচ্চবংশীয়।
দাদা চিঠি নিয়ে বাজারে গেলেন। একটি মুদি দোকানে বসলেন। দোকানদারকে বললেন, ‘এই নিমাই সাহা, আমার আশপাশে যেন কেউ না আসে। জরুরি চিঠি লিখব।’
দাদা যা লিখলেন তা অনেকটা নিম্নরূপ—
আল্লাহ ভরসা
আশা করি ভালো আছো। পর সমাচার এই যে, ছেলেকে আমাদের খুবই পছন্দ হইয়াছে। ছেলের চাকরি ভালো। উপরি টাকাও আছে। ছেলের বাবা খুবই সজ্জন। গোলাভরা ধান। বাড়িতে চারটি দুধের গাই আছে। এই সম্মন্ধ কিছুতেই হাতছাড়া করা যায় না। এই পত্র পাওয়ার এক হপ্তার মধ্যে বাড়িতে চলিয়া আসো। ধুমধাম করিয়া বিবাহ হইবে।

বিবাহের বাজার সওদা কলিকাতাতেই ভালো হইবে। যথাসাধ্য নিয়া আসিবে।—
চিঠি পাঠানোর তেরদিনের মাথায় মেয়ের বড় ভাই কলকাতা থেকে বাজার সওদা নিয়ে গ্রামে হাজির।
এই ঘটনায় মেয়ের বাড়িতে যথেষ্ট ক্যাওয়াজ হলো বটে। তবে বিয়ে ফেরানো গেল না। আজিমা খাতুনের সঙ্গে আবদুল ওহাবের বিয়ে সম্পন্ন হলো ধুমধামের সঙ্গে।
কিছুদিন পর নববধূ নিয়ে আবদুল ওহাব স্টিমারে চড়লেন কলকাতার উদ্দেশ্যে। এখানকার মইনটঘাট (মিনি কক্সবাজার) ছিল স্টিমার ঘাট। সেখান থেকে স্টিমার ছেড়ে যেত রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দে। গোয়ালন্দ থেকে ট্রেনে চেপে সোজা কলকাতা। শিয়ালদা স্টেশন।

আবদুল ওহাব সাহেবের ঘরে সাত সন্তানের জন্ম হলো। ওহাব সাহেব বলছি কেন?
আমাদের জন্ম শুরু হলো। কলকাতায় জন্ম হলো আমার বড়বোন পারুল, নাজমা, ভাই আঞ্জুম এবং পুলকের। আমার এক বোন বেলা তার নাম। সে নাকি দেখতে খুব সুন্দর ছিল। মায়াভরা চেহারা। তিন বছর বয়সে সে মারা গেল কলকাতা শহরের বেগবাগানে।
মাকে একটা সময় ছেলেমেয়েকে নিয়ে কলকাতা থেকে গ্রামে চলে আসতে হলো। সেটা দাদার আগ্রহেই। তবে আব্বা চাকরি নিয়ে থেকে গেলেন কলকাতাতে।

বকচরে জন্ম হলো ছোট বোন বিলকিস ও আমার। আমাদের ঘর ছিল চারটা। একটা ঘরের নাম ছিলো বড় ঘর। আরেকটার নাম দিলো টালির ঘর। টালি দিয়ে ঘরের চাল ছাওয়া। পুব দিকের ঘরটাকে বলতাম পূবের ঘর।  আরেকটা ঘরের নাম ছিল নতুন ঘর।
আমার জন্ম হলো টালির ঘরে। আমার চেহারা দেখে দাদা মুনির উদ্দিন উচ্ছসিত হলেন। বললেন, ‘আমার নাতি ঘর আলো করে দিয়েছে। রশনিতে ভরে গেছে। ওর নাম থাক রতন।’
দাদা আরো বললেন, আমার দাদার নামও ছিল রতন। আমার এই নাতির মাধ্যমে দাদার স্মৃতিটাও ধরে রাখা যাবে।

গ্রামে ছিল দাইমা।কারও প্রসব বেদনা উঠলেই তাদের ডাক পড়ত। তারা ছুটে আসতেন ‘ছটিবাড়ি’। ছটিবাড়ি মানে- যে বাড়িতে সন্তান জন্ম হয়, সে বাড়িকে ছটি বাড়ি বলা হতো। আর যে ঘরে শিশুর জন্ম হতো সে ঘরকে বলা হতো ছটি ঘর।
ইছামতি নদীর পাড়ে ছিল সুলতানদের বাড়ি। সুলতানের মা দাইয়ের কাজ করতেন। এই কাজ করে তার একরকম ব্যস্ত দিন কাটত। দাইগিরি করে তার সংসার চলত।

দাদাকে খুব একটা পাইনি। তার চেহারা ঝাপসা মনে পড়ে। বাড়িতে মাগরিবের নামাজ শেষে তিনি আমাকে মাঝে মাঝে  তার কাধে চড়াতেন। আমাদের বিলেতি গাব গাছের নিচে আমাকে কাধে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করতেন।
আরেকটা দৃশ্যের কথা মনে পরে। দাদার হাতে-পায়ের আঙুলে ঘা হলো। পচন ধরেছে। সারা বাড়িতে পঁচা গন্ধ। তার বিছানার সামনে টেবিল। টেবিলে ওষুধের শিশি। আঙুর, আপেল। আমার ছোট ফুপু তাকে চিনি ভেজানো শরবত দিচ্ছেন।
ফুপু বলছেন, ‘খাও, খাও। তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাবে।’

আমার দাদির বয়স হয়ে যাওয়ার পর বেশ অসুস্থ ছিলেন।
দাদি একদিন আবিস্কার করলেন, তিনি যেখানে পেশাব করেন, সেখানে পেশাব শুকিয়ে যাওয়ার পর চারদিক থেকে পিঁপড়ারা ভিড় করে।
দাদা-দাদি দুজনই অসুস্থ হয়ে মারা গেলেন।

অনেক আগে একদিন আমার বড় ভাই আসাদুজ্জামান আঞ্জুম বলেছিলেন, ‘নিশ্চিত দাদা-দাদির ডায়াবেটিস হয়েছিল। সে সময় ডায়াবেটিসের কোনো ডাক্তার ছিল না গ্রামে। অতিরিক্ত ডায়াবেটিসে দাদার হাতের আঙুলে পচন ধরেছিল আর তাকে কিনা চিনি গুলিয়ে খাওয়ানো হতো।
চিকিৎসা বিহীন মারা যেত কত মানুষ!

একবার গ্রামে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দিলো। গ্রামের মানুষ কলেরায় মারা যাচ্ছে। প্রত্যেক বাড়ির মানুষ আতঙ্কে ভুগছে। কখন তাদের বাড়িতে কলেরা এসে হানা দেয়। বাড়িতে বাড়িতে দোয়া-দরুদ পড়া হচ্ছে। মৌলানা সাহেবের কাছ থেকে ‘পানি পড়া’ নিয়ে আসা হচ্ছে। সে পানি ছিটানো হচ্ছে বাড়ির সর্বত্র।

শুধু মৃত্যু সংবাদের খবর আসছে। আর আমরা ভয়ে জড়োসড়ো হচ্ছি। ভয়ে কেউ লাশ কবর দিতেও যাচ্ছে না। যদি তার আবার কলেরা হয়ে যায়!
আমাদের পাশের বাড়ির চারজন মারা গেলেন একদিনেই।

গ্রামের তরুণরা সন্ধ্যায় বের হতেন জিকির করতে। পুরো গ্রাম ঘুরে ঘুরে জিকির করা হতো। সে দলে আমিও সুযোগ পেয়েছিলাম। একটি হারিকেন নিয়ে সামনে একজন থাকত। আমরা পিছনে পিছনে দোয়া-দরুদ পড়তাম উচ্চস্বরে। যাতে গ্রাম থেকে বালামুসিবত দূর হয়ে যায়। জিকির করতে করতে আমরা পুরো গ্রাম প্রদক্ষিণ করতাম। গ্রামের মোল্লা সাহেব আলী হোসেন বিশ্বাসের কাছ থেকে আমরা জিকিরের কথা লিখে নিতাম। সেগুলো ছন্দবদ্ধভাবে পড়া হতো।

আমাদের পাশের গ্রাম তুইতাল। তুইতাল ছিল শামীমের মামার বাড়ি। সেই শামীমও কলেরা-বসন্ত দূর করার জন্য জিকির করত। তার ছিল উচ্চকন্ঠ। সেই শামীম আহমেদ চৌধুরী এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের বড় ডাক্তার। এই শামীমকে যদি তখন ডাক্তার হিসেবে পাওয়া যেত। এখনকার পাঁচ টাকা দামের স্যালানই কত মৃত্যু ঠেকিয়ে দিতে পারত!